‘ফিস-সামা’ ও ‘আলাল আরশ’
উস্তাদ শাইখুল ইসলাম হাফি.
১.
.
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা কি আসমানে না আরশের উপরে, এটা নিয়ে জাহমের অনুসারীরা পূর্বেও বিভ্রান্তি তৈরির কোশেশ করেছে। অনেক নস ও আসারে في السماء (আসমানে) বলা হলেও অন্য অনেক নস ও আসার বলছে আল্লাহ على العرش (আরশের ওপরে)। দু’টি কথার মধ্যে মূলত কোনো বিরোধই নেই। উভয় নসের সারমর্ম হলো আল্লাহ আসমানের উপরে, আরশের ঊর্ধ্বে। প্রথম নসে ‘সামা’ শব্দের অর্থ হলো ‘উলু’ (العلو) বা ওপর। তখন ফিস-সামা’র অর্থ হয় ‘আল্লাহ ওপরে’। আবার সামাকে আসমান অর্থে ধরলেও তখন ‘ফি’ (في) অর্থ হয় ‘আলা’ (على) বা ‘ওপর’। এমতাবস্থায় ফিস-সামা’র অর্থ হয় ‘আল্লাহ আসমানের ওপরে’।
মনগড়াভাবে এই অর্থ গ্রহণ করা হয়নি; বরং দু’টি উসুলের ভিত্তিতে উক্ত অর্থ নেয়া হয়েছে। এক. আল্লাহ কুরআনে নিজের জন্য যা কিছু সাব্যস্ত করেছেন তা সাব্যস্ত করতে হবে। যেমন, তিনি সমগ্র সৃষ্টির উপরে থাকা এবং আসমান জমিন সৃষ্টির পর তাঁর আরশের উপরে ওঠা। দুই. কোনো মাখলুক দ্বারা তিনি পরিবেষ্টিত বা অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি সবকিছু থেকে অমুখাপেক্ষী। এ উভয় মূলনীতি কুরআন থেকেই নেয়া। একদিকে তিনি বলছেন, তিনি আরশের উপরে ওঠেছেন, আবার বলছেন তিনি কোনো মাখলুক দ্বারা আবদ্ধ বা মুখাপেক্ষী নন। তাই যেসব নস ও আসারে في السماء (আসমানে) শব্দ উল্লেখ রয়েছে, সেসবের এমন অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যা উপরোক্ত নুসুসভিত্তিক মূলনীতির অনুকূলে এবং আরবি অভিধানেও সে অর্থ বিদ্যমান। সামা’র অর্থ আসমান হওয়ার পাশাপাশি এর অর্থ ‘ওপর’ বা উপরের শূণ্যস্থানও হয়। আরবি অভিধানে শব্দটির যেসব অর্থ পাওয়া যায় তা হলো, ‘আকাশ’, ‘ভুমির বিপরীত বস্তু’, ‘উপরের শুণ্যস্থান’, ‘প্রত্যেক বস্তুর উপরের দিক’, ‘মেঘমালা’, ‘বৃষ্টি’ ইত্যাদি।
অভিধানে আছে বলেই সালাফ থেকেও في السماء শব্দের অর্থ ‘ওপরে’ প্রমাণিত রয়েছে। সামা অর্থ ‘ওপর’ (العلو) নিলে অর্থ হয় ‘তিনি ওপরে’, আর ‘ফি’ অর্থ ‘আলা’ (على) নিলে অর্থ হয় ‘তিনি আসমানের ওপরে’। যেমনটি আল্লাহ বলেছেন,
فَسِيحُوا فِي الْأَرْضِ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ.
وَلَأُصَلِّبَنَّكُمْ فِي جُذُوعِ النَّخْلِ .
فسيروا في الأرض.
সবগুলো আয়াতেই ‘ফি’ অর্থ ‘আলা’ হওয়ার বেলায় কারো দ্বিমত নেই।
সালাফ থেকেও এই অর্থ প্রমাণিত :
ইমাম বুখারির (রাহিমাহুল্লাহ) উসতায আলি ইবনুল হাসান ইবনি শাকিক (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আমি আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারাককে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের রবকে কিভাবে চিনব? তিনি জবাব দিলেন,
في السماء السابعة على عرشه
‘সাত আসমানের উপরে আরশের ঊর্ধ্বে।’
তিনি এ-ও বলেছেন যে,
على السماء السابعة على عرشه، ولا نقول كما تقول الجهمية إنه ها هنا في الأرض
‘সাত আসমানের উপরে আরশের ঊর্ধ্বে। আর জাহমিয়াদের মতো আমরা বলি না যে, তিনি এখানে জমিনেই রয়েছেন।’
ইমাম আহমাদ বিন হামবালকে যখন কথাটি বলা হল, তখন তিনিও বললেন, هكذا هو عندنا ‘আমাদেরও একই মত।’
এই দীর্ঘ আলোচনাটি উল্লেখ করে ইমাম যাহাবি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,
هذا صحيح ثابت عن ابن المبارك، وأحمد رضي الله عنهما. وقوله “في السماء” رواية أخرى توضح لك أن مقصوده بقوله “في السماء” أي: على السماء.
‘এটি ইবনুল মুবারাক ও আহমাদ রাদিআল্লাহু আনহুমা থেকে সহিহভাবে সাব্যস্ত। আর অন্যান্য বর্ণনা ‘ফিস-সামা’ (في السماء) শব্দের ব্যাখ্যা করছে যে, এর উদ্দেশ্য হলো على السماء (আসমানের ওপরে)।’
[দেখুন : ইমাম যাহাবি, আল-আরশ, খণ্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৩৮-৩৯-৪০, মাকতাবা শামিলা]
মোটকথা, ‘ফিস-সামা’ শব্দের অর্থ ‘ওপরে’ করা এটি তাবিল নয়; বরং শব্দের একাধিক অর্থসমূহের একটি, যা নুসুস, সালাফের আমল ও অভিধানে বিদ্যমান।
তাই নুসুস ও নুসুসভিত্তিক উসুল এবং সালাফদের বুঝ অনুযায়ী আরবি অভিধানের অনুকূলে কোনো অর্থ নেয়া, আর নিজেদের ভ্রান্ত আকিদাহ টিকিয়ে রাখতে কোনো কারণ ছাড়াই শব্দের আসল অর্থ বর্জন করে দূরবর্তী কিংবা শব্দের সাথে যোগসূত্রহীন কোনো অর্থ নেয়া কখনো এক নয়।
প্রাসঙ্গিক : সিফাতের কাইফিয়াত তাফবিদ করার পরও প্রকাশ্য অর্থ শুনলেই যদি কারো তাশবিহ ও তাজসিমের কল্পনা মাথায় আসে, তাহলে এটাও মুশাব্বিহা, মুজাসসিমা বা সাদৃশ্যবাদি ও দেহবাদিদের লক্ষণ।
২.
‘ফিস-সামা’ অর্থ ‘আলাস সামা’ (على السماء)। في অর্থ على হওয়া কুরআনের অন্য একাধিক আয়াতেও বিদ্যমান। যেমন আল্লাহ (সুব.) বলেছেন,
فَسِيرُوا فِي الأرْضِ
‘তোমরা জমিনে ভ্রমণ কর।’
فَسِیۡحُوۡا فِی الۡاَرۡضِ اَرۡبَعَۃَ اَشۡہُرٍ
‘তোমরা জমিনে চারমাস সময় পরিভ্রমন কর।’
আয়াতদু’টিতে ‘ফিল আরদ’ অর্থ ভূমির ভেতরে নয়; ভূপৃষ্ঠে, জমিনের উপরে।
وَّلَاُصَلِّبَنَّکُمۡ فِیۡ جُذُوۡعِ النَّخۡلِ
‘আমি তোমাদেরকে খেজুর গাছের কাণ্ডে শুলিবিদ্ধ করবই।’
এখানেও (فِیۡ جُذُوۡعِ النَّخۡلِ) ‘আলা’ অর্থে এসেছে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি,
১. আমি ছাদের মধ্যে আছি
২. আমি ছাদের ওপর আছি
৩. আমি ছাদে আছি
সবগুলো কথার কি একই অর্থ নয়? একটা বাচ্চাও সবগুলোর প্রকাশ্য অর্থ একই বুঝবে। এগুলো তাবিল না। আগের পোস্টে খোলাসা করেছি।
ইমাম মালিকও (রাহিমাহুল্লাহ) ‘ফিস-সামা’ বলে আল্লাহর ওপরে থাকা সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন,
مَنْ قَالَ الْقُرْآنُ مَخْلُوقٌ يُوجَعُ ضَرْبًا وَيُحْبَسُ حَتَّى يَمُوتَ. وَقَالَ : اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِي السَّمَاءِ وَعِلْمُهُ فِي كُلِّ مَكَانٍ لَا يَخْلُو مِنْهُ شَيْءٌ
‘যে ব্যক্তি কুরআনকে মাখলুক (সৃষ্ট) বলবে, তাকে পিটিয়ে কষ্ট দিতে হবে এবং আমৃত্যু বন্দি করে রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আল্লাহ (আযযা ওয়া জাল্লা) আসমানে আছেন। তাঁর ইলম (জ্ঞান) রয়েছে সর্বত্র এবং কোনো কিছুই তাঁর থেকে মুক্ত নয়।’
[আবদুল্লাহ ইবনু আহমাদ ইবনি হামবাল, আস-সুন্নাহ, খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ১০৬, বর্ণনা নং : ১১; এর সনদ সহিহ]