শাইখ ড. আবদুল্লাহ ইউসুফ (রাহ.)- এর
সভ্যতা বিনির্মাণে আকিদাহ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় থেকে।
তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত | পর্ব- ২ |
__
৩. সিফাতের মাসয়ালায় সালাফদের মাজহাবঃ
সালাফদের মাযহাবের মূল ভাষ্য হচ্ছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতগুলো ওইভাবেই প্রয়োগ করা, যেভাবে কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত হয়েছে।
তাঁরা যখন এ ধরনের আয়াতের মুখোমুখি হন― يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ (আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর) [সূরা ফাতহ | ১০] তখন তাঁরা বলতেন, আমরা হাতকে সাব্যস্ত করি, এর প্রতি ইমান রাখি ও সত্যায়ন করি। কিন্তু আমরা এর কাইফিয়াহ [1] নিয়ে প্রশ্ন করি না, আবার তাতিলও করি না।
ইমাম খাত্তাবি রহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৩৮৮ হি.) এই মাযহাবের একটি সারসংক্ষেপ উল্লেখ করেছেন, একখণ্ড সংক্ষিপ্ত মজবুত ভাষ্যে এর ওপর দলিল উপস্থাপন করেছেন। বক্তব্যটি চমৎকার, সুসংক্ষিপ্ত। আমি এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেন, ‘সালাফদের মাযহাব হলো, তাঁরা সিফাতসংক্রান্ত সব আয়াত ও হাদিসকে এর প্রকাশ্য (ظاهر) অর্থের ওপর প্রয়োগ করতেন। সাথে সাথে কাইফিয়াত ও তাশবিহ [2] অস্বীকার করতেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতের ওপর কালামের প্রয়োগ করা মূলত তাঁর মহান সত্তার ওপর কালামের ধারা চালু করার নামান্তর। এ ব্যাপারে আল্লাহর সত্তার মাঝে কালামেরই পদচিহ্ন ধরে চলতে হয়, তাঁর মিসালের পেছনে পড়তে হয়। যেহেতু আল্লাহর সত্তাকে সাব্যস্ত করার মানে আল্লাহর অস্তিত্বকেই সাব্যস্ত করা, তাই তাঁর সিফাত সাব্যস্ত করার মানেও হলো তাঁর অস্তিত্বকে সাব্যস্ত করা। এটি কোনো ধরনের কাইফিয়াত সাব্যস্তকরণ নয়। তাঁরা বিষয়টিকে নিজেদের ভাষায় এভাবে ব্যক্ত করতেন যে, সিফাতগুলো যেভাবে বর্ণিত হয়েছে সেভাবেই প্রয়োগ হবে। কোনোরকম তাবিলের পেছনে পড়া যাবে না। এ কথার মাধ্যমে তাঁদের উদ্দেশ্য হলো, ধরন বর্ণনা করা ছাড়াই আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করতে হবে। সালাফদের দিকে সম্বন্ধকারী কিছু লোক ধারণা করে যে, সালাফরা এই কথার মাধ্যমে তাফবিদ [3] উদ্দেশ্য নিয়েছেন অথবা তাদের ধারণা, এগুলো মুতাশাবিহাতের অর্ন্তভুক্ত; এ সবই তাদের ভুল ধারণা।’[4]
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ওপর বিশ্বাসের অন্যতম অংশ হচ্ছে, নিজ কিতাবে তিনি নিজেকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে তাঁকে গুণান্বিত করেছেন, কোনো প্রকার তাহরিফ, তাতিল, তাকয়িফ এবং তামসিল ছাড়াই এর ওপর ইমান আনা।’ [5]
আবার কেউ কেউ বলেছেন, ‘সামগ্রিকতা ও সাব্যস্তকরণের দিক থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতগুলো জানা আছে, তবে ধরন নির্ধারণ ও সীমাবদ্ধকরণের দিক থেকে তা একেবারেই অবোধগম্য।’ [6]
তাহরিফ (বিকৃতিসাধন) : কোনো নসকে শব্দগত বা অর্থগতভাবে বিকৃত করা।
তাকয়িফ (ধরন-নির্ধারণ) : كيف শব্দ দ্বারা প্রশ্ন করা। অর্থাৎ এটি কেমন বা কী ধরনের, এ জাতীয় প্রশ্ন করা।
তামসিল (তুলনাকরণ) : কোনো বস্তুর জন্য অন্য একটি বস্তুকে সাদৃশ্যপ্রদান করা, যে বস্তুটি সবদিক থেকে তার মতো হয়।
তাশবিহ (সাদৃশ্যকরণ) : কোনো একটি বস্তুকে অন্য একটি বস্তুর সাথে সাদৃশ্যস্থাপন করা, তবে সে বস্তুটি কিছু কিছু দিক থেকে তার সাথে সাদৃশ্য রাখে।
ইমাম আবুল কাসিম আললালকায়ি ‘উসুলুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে ইমাম আবু হানিফাহ রহিমাহুল্লাহর ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন,
‘দুনিয়ার পূর্ব থেকে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত যত ফুকাহা কিরাম আছেন সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, কুরআনের ওপর ইমান আনতে হবে এবং গ্রহণযোগ্য বর্ণনাকারীরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতের ব্যাপারে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যেসব হাদিস বর্ণনা করেছেন, কোনো ব্যাখ্যা, ভিন্ন কোনো বিশেষণ ব্যবহার ও সাদৃশ্যস্থাপন ছাড়াই ওইসব হাদিসের ওপরও ইমান আনতে হবে। সুতরাং আজকের যামানায় কেউ যদি ওগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করে, তাহলে সে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পথের ওপর ছিলেন তা থেকে বের হয়ে গেছে এবং সাহাবা আজমায়িনের জামায়াতকে ত্যাগ করেছে। কারণ, তারা ভিন্ন কোনো বিশেষণ ব্যবহারও করেননি, ব্যাখ্যাও করেননি; বরং কুরআন-সুন্নাহয় যা আছে তার ওপরই ফাতওয়া দিয়েছেন, তারপর চুপ থেকেছেন।’ [7]
ইমাম আবু হানিফাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন,‘তাঁর হাত, মুখ ও সত্তা রয়েছে, যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনুল কারিমে বর্ণনা দিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যে চেহারা, হাত ও সত্তার আলোচনা করেছেন, সেগুলো কোনো ধরনের কাইফিয়াত ছাড়াই তাঁর সিফাত। তাঁর হাতকে কুদরত বা নিয়ামত বলা যাবে না। কারণ, তাতে সিফাতকে বাতিলকরণের শঙ্কা আছে। এই ব্যাখ্যা ও মতবাদ কাদরিয়াহ ও মুতাযিলাদের উদ্ভব; বরং হাত তাঁর সিফাত, তবে কাইফিয়াত ছাড়া।’ [8]
আমাদের রব দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন (ينزل ربنا الي سماء الدنيا) [9]
এবং আল্লাহ তাঁর পা অবতরণ করান (ان الله يضع قدمه)
এ ধরনের নসের ক্ষেত্রে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘আমরা এর ওপর ইমান আনি, সত্যায়ন করি, তবে এগুলোর কোনো অবস্থা ও কাইফিয়াত নেই, কোনো অর্থও নেই। [10]
আমরা এগুলোর কোনো কিছু প্রত্যাখ্যান করি না। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন―যদি সহিহ সনদ দ্বারা বর্ণিত হয়―সবই সত্য। আমরা তাঁর কোনো কথাই প্রত্যাখ্যান করি না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিজেকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন―সীমা ও পরিসীমা ছাড়াই―তারচেয়ে বেশি ও বাড়িয়ে বর্ণনা করা করা যাবে না। তাঁর মতো কোনো কিছুই নেই।’ [11]
ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ যখন এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন, يَدُ اللَّهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ (আল্লাহর হাত তাদের হাতের ওপর) তখন তিনি নিজের হাতের দিকে ইশারা করতেন; অথবা যখন তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করতেন, وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ (তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা) তখন তিনি নিজের চোখ ও কানের দিকে ইশারা করতেন। কারণ, এই ইশারাকৃত অঙ্গ কেটে দেয়া হবে, এ তো নিজের সাথে আল্লাহকে তুলনা করার নামান্তর।
ইমাম ফখরুল ইসলাম বাযদাবি রহিমাহুল্লাহ বলেন,
‘হাত ও চেহারা সাব্যস্ত করা আমাদের কাছে সত্য। কিন্তু এটি আসল হিসাবেই বিশ্বাস করা হয় এবং তার সিফাতের সাথে সাদৃশ্য মনে করা হয়। সুতরাং কাইফিয়াত বর্ণনা করা থেকে অক্ষম হওয়ার কারণে সিফাতকেও বাতিল করা যাবে না। মুতাযিলারা এই জন্যই পথচ্যুত হয়েছে। তারা যুক্তিগ্রাহ্যভাবে সিফাত সম্পর্কে না বুঝতে পেরে মূল সিফাতগুলোই প্রত্যাখ্যান করে বসে। ফলে মুয়াত্তিলাহগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।’ [12]
.
.
৪. সিফাতের মাসয়ালায় খালাফদের মাযহাবঃ
এই মতের অনুসারীরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে দেহবাদের দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত করার জন্য তাঁর কিছু কিছু সিফাতকে ব্যাখ্যা করা বৈধ মনে করতেন। তবে তারা এ ব্যাপারে সালাফদের সাথে একমত যে, আয়াতগুলোর উদ্দেশ্য এমনসব অর্থ ও উদ্দেশ্যের বিপরীত যা মানুষের মাথায় আসে।
আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ তাঁর دفع شبه التشبيه (সাদৃশ্যবাদের সংশয় নিরসন) গ্রন্থে বলেন, ‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
‘ধ্বংস হবে না কেবল তোমার মহামহিম ও চিরসম্মানিত রবের চেহারা।’
[সুরা রাহমান | ২৭]
মুফাসসিরগণ বলেন, এর অর্থ হলো ‘তোমার রব বাকি থাকবেন।’ এমনিভাবে তারা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার বাণী, يُرِيدُونَ وَجْهَهُ (তারা আল্লাহর চেহারা কামনা করে)-এর তাফসির করেছেন, يريدونه (তারা আল্লাহকে চায়)। এমনিভাবে দাহহাক ও আবু উবাইদাহ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ (সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবে, শুধু তাঁর চেহারা ছাড়া) আয়াতের তাফসির করেছেন, إِلَّا هُوَ অর্থাৎ তিনি ছাড়া।’
ইমাম ইবনুল জাওযি রহিমাহুল্লাহ মনে করতেন, আয়াতের বাহ্য অর্থ গ্রহণ করা সাদৃশ্যবাদ ও দেহবাদের অন্তর্ভুক্ত। কারণ, শব্দের বাহ্য অর্থের জন্যই শব্দটিকে গঠন করা হয়েছে। সুতরাং يد (হাত) শব্দটির হাকিকি অর্থ جارحة বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাড়া অন্য কিছুই বুঝে আসে না। তিনি বলেন, ‘সালাফদের মানহাজ হচ্ছে, এসব আয়াতের ব্যাপারে সুকুত ইখতিয়ার করা বা চুপ থাকা। তাঁরা কখনোই আয়াতের বাহ্য অর্থ ও মর্ম গ্রহণ করতেন না।’ [13]
.
আমাদের মাযহাবঃ
সিফাতের আকিদাহর ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মাযহাবই আমাদের মাযহাব। এ ব্যাপারে আমরা সালাফদের মাযহাবই গ্রহণ করেছি। যার সারমর্ম হলো,
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সুমহান সিফাতসহ তাঁর নামগুলো সাব্যস্ত করা এবং একমাত্র তাঁর জন্যই সাব্যস্ত করা; কোনো প্রকার তাবিল[14], তাতিল, তাহরিফ[15] , তাকয়িফ, তামসিল ছাড়াই। আমাদের বিশ্বাস, সালাফরা সিফাতগুলো (বাহ্য অর্থে) ইসবাত করতেন, তাফবিদ (অর্থ না জানার দাবি) করতেন না। আমরা বিশ্বাস করি, তাঁরা আল্লাহর আসমা ও সিফাতগুলোকে মুতাশাবিহ [16] মনে করতেন না; বরং তাঁরা ওগুলোর অর্থ জানতেন, কিন্তু ধরন নিয়ে প্রশ্ন করতেন না। কারণ, ধরন অজানা। আমরা এ ব্যাপারে ওই কথাই বলব, যা ইমাম মালিক রহিমাহুল্লাহ বলেছেন,‘ইস্তিওয়া (আরশে সমুন্নত হওয়া) বোধগম্য, তবে ধরন অবোধগম্য। এর প্রতি ইমান আনা ওয়াজিব, প্রশ্ন করা বিদয়াত।’ [17]
আমরা ইস্তিওয়াকে প্রভাব বিস্তারকরণ বা ক্ষমতাগ্রহণ অর্থ করব না। নুযুল বা আল্লাহর অবতরণের বেলায়ও একই কথা। এমনিভাবে আমরা বলব, তাঁর হাত রয়েছে, তবে আমাদের হাতের মতো নয়। আবার তাঁর হাতকে আমরা কুদরত বা ক্ষমতাও বলব না।
আমরা বলব,‘সালাফদের মাযহাবই হলো সবচেয়ে নিরাপদ, জ্ঞানগর্ভ ও প্রজ্ঞাময়।’
এ কথা বলব না যে, ‘সালাফদের মাযহাব নিরাপদ, আর খালাফদের মাযহাব প্রজ্ঞাময়।’
আমরা বলি, সালাফদের মাযহাবই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের মাযহাব। (তাঁর মতো কোনো কিছুই নেই, তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।) পরবর্তী কিছু আলিম, যারা তাবিলের পক্ষপাতী ছিলেন, যেমন, আশয়ারিগণ, তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত। তবে সিফাতের তাবিলের ক্ষেত্রে তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের অনুগামী নন। আমরা এই বিশ্বাস রাখি যে, আশয়ারিরা কাফির নয়, তাবিলের কারণে তারা মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজও নয়; বরং তারা এ ব্যাপারে ভুল করেছেন। বিশেষ করে ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলিম উম্মাহর অসংখ্য আলিম-উলামা তাবিল করেছেন। তাদের বড় অংশ জুড়েই ছিলেন ফিকহ, তাফসির ও ইলমুল হাদিসের উজ্জ্বল নক্ষত্র ও মহান কীর্তিমান সন্তানগণ। তাবিলের প্রতি তাদের ঝুঁকে যাবার কারণ ছিল, সাদৃশ্যবাদ থেকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালাকে পবিত্র রাখা। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদের সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন। পদস্খলিত ও পথচ্যুতদের ক্ষমা করেন।
‘হে আমাদের রব, আমাদেরকে পথপ্রদর্শনের পর আমাদের হৃদয়কে বক্র ও করে দেবেন না। আপনার পক্ষ থেকে আমাদেরকে দয়া ও অনুগ্রহ দান করুন। আপনিই অধিক দাতা।’
[সূরা আলি ইমরান | ৮]
তা ছাড়া অসংখ্য সত্যবাদী ব্যক্তি সালাফদের মাযহাবে ফিরে এসেছিলেন। তাঁদের মাঝে অন্যতম হলেন আবুল হাসান আশয়ারি রহিমাহুল্লাহ। তিনি এর আগে মুতাযিলাদেরও নেতা ছিলেন। সেই ভ্রান্তি থেকে ফিরে এসে মুতাযিলাদের বিরুদ্ধে তিনশতেরও বেশি বই-পুস্তক রচনা করেন।
তিনি তাঁর الابانة عن اصول الديانة এবংمقالات الاسلاميين গ্রন্থদ্বয়ে নিজ আকিদাহর বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের আকিদাহর সারকথা হলো, আমরা আল্লাহকে স্বীকার করি, তাঁর মালায়িকাহ, কিতাবসমূহ ও রাসুলদের স্বীকার করি। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন সেগুলোও স্বীকার করি এবং নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীগণ যা বর্ণনা করেছেন তাও স্বীকার করি। আমরা এর কোনো কিছুই প্রত্যাখ্যান করি না….।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার চেহারা রয়েছে, যেরকম তিনি বলেছেন,
‘ধ্বংস হবে না কেবল তোমার মহামহিম ও চিরসম্মানিত রবের চেহারা।’
[সূরা আর রাহমান | ২৭]
তাঁর দুই হাত রয়েছে, তবে কাইফিয়াত মুক্ত। যেমন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,
خَلَقْتُ بِيَدَيَّ
‘আমি আমার উভয় হাত দিয়ে তাকে সৃষ্টি করেছি।’ [সূরা সাদ | ৭৫]
بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ
‘বরং তাঁর উভয় হাত বিস্তৃত হয়ে আছে।’ [সূরা মায়িদাহ | ৬৪]
এমনিভাবে তাঁর দুই চোখ রয়েছে, তবে কাইফিয়াত মুক্ত।
তিনি বলেন,
تَجْرِي بِأَعْيُنِنَا
‘ যা (নৌকাটি) আমার চোখের দৃষ্টির সামনে) সামনে ভ্রমণ করবে।’[সূরা কামার | ১৪]
[সমাপ্ত]
টীকা:
[1] ধরন : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতের প্রকৃতি বা রকম। [সম্পাদক]
[2] তাশবিহ অর্থ তুলনাকরণ, সাদৃশ্যকরণ। অর্থাৎ, সৃষ্টির সিফাতের সাথে আল্লাহর সিফাতের তুলনা দেয়া। [সম্পাদক]
[3] শব্দের বাহ্য অর্থ না করে অর্থকে আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা। [অনুবাদক]
[4] রাওদাতুন নাদিয়াহ, পৃষ্ঠা : ৩২
[5] আলআকিদাতুল ওয়াসিতিয়াহ, পৃষ্ঠা : ৮
[6] শারহুল আকিদাতিল ওয়াসিতিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১২
[7] শারহু উসুলি ইতিকাদি আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামায়াহ, পৃষ্ঠা : ১৮৬
[8] আলফিকহুল আকবার, পৃষ্ঠা : ১৬৭-১৬৮; (দারুল কিতাব, বৈরুত, হিজরি : ১৩৯৯)
[9] এ ব্যাপারে অসংখ্য সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে। ইমাম বুখারি রহিমাহুল্লাহ সহিহুল বুখারিতে তাহাজ্জুদ অধ্যায়ে (হাদিস নং : ১১৪৫) এবং ইমাম মুসলিম রহিমাহুল্লাহ তাঁর সহিহ মুসলিমে সালাত অধ্যায়ে (হাদিস নং : ১৮০৮)
[10] এর ব্যাখ্যায় শাইখুল ইসলাম রহিমাহুল্লাহ বলেন, أي لا نكيفها ولا نحرفها بالتأويل―আমরা এর কোনো ধরন বর্ণনা করবো না এবং অপব্যাখ্যার মাধ্যমে বিকৃতও করব না। [দারয়ু তায়ারুদিল আকলি ওয়াননাকল, ২/৩১] [অনুবাদক]
[11] কিতাবুল আরশ, পৃষ্ঠা : ১১৫
[12] ইদাহুদ দালিল, পৃষ্ঠা : ৪১
[13] দাফয়ু শুবহাতিত তাশবিহ, পৃষ্ঠা : ১৫৩ (দারুল ইমাম আননাওয়াবি, জর্ডান, হিজরি : ১৪১৩)
[14] তাবিল শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা। মুতাআখখিরিন উলামা কিরামের মতে তাবিল হলো কোনো শব্দের বাহ্য অর্থ পরিত্যাগ করে এর অন্য অর্থ উদ্দেশ্য নেয়া। [সম্পাদক]
[15] তাহরিফ অর্থ বিকৃতিসাধন। কোনো নসকে শব্দগত বা অর্থগতভাবে বিকৃত করা। আল্লাহর সিফাতের অপব্যাখ্যা করা, সিফাতের সঠিক অর্থকে পরিবর্তন করে এমন অর্থ নির্ধারণ করা, যা নুসুস দ্বারা প্রমাণিত নয়। [সম্পাদক]
[16] মুতাশাবিহ―যার অর্থ ও উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহই জানেন। যেমন, কুরআনের বিভিন্ন সুরার শুরুতে থাকা বিচ্ছিন্ন বর্ণগুলো। [অনুবাদক]
[17] শারহুল আকিদাতিত তাহাবিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১০৫