প্রশ্ন: কাকে “আলিম” উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা সঠিক হবে? যে কোনো ইসলামী মুদাররিস(লেকচারার) কে কি এই উপাধি দ্বারা সম্বোধন করা সঠিক হবে নাকি কেবল প্রবীণ মাশাইখদেরই আলিম বলা যাবে?
জবাব:
الحمد لله
আলিম, ফকিহ ও মুজতাহিদ এই উপাধিগুলো একই অর্থ নির্দেশ করে। তা হল: যিনি তার সামর্থ্যকে শরঈ বিধান প্রতিপাদনে ব্যয় করেন, এবং শরীআতের যে দলীলসমূহ রয়েছে (তথা কুরআন,সুন্নাহ, ইজমা, কিয়াস) তা থেকে শরঈ বিধান প্রতিপাদনের সামর্থ্য-সক্ষমতা তার রয়েছে।
অর্থাৎ তার কাছে ইজতিহাদের মাধ্যম বা উপায় থাকতে হবে। যার মাঝে ইজতিহাদের শর্তসমূহ পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান নেই তাকে আলিম, মুজতাহিদ, ফকিহ এসব অভিধায় ভূষিত করা যাবে না।
আলিমগণ এই শর্তসমূহের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছেন যেন ছোট বা বড় যে কেউ আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে বিনা জ্ঞানে যে কোনো কথা বলে দেয়ার দরজা খুলে না যায়।
তবে আমরা কেবল দুটা উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ক্ষান্ত দেব যার মাধ্যমে আমরা এই শর্তসমূহ পেয়ে থাকি:
প্রথম উদ্ধৃতি, ইমাম শাওকানী رحمه الله এর। তিনি যা আলোচনা করেছেন তা থেকে আলিম হওয়ার জন্য ৫টি শর্ত পাওয়া যায়:
১) ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞানী হবে। তিনি আলিম হবার জন্য হাদিসের হাফিয হওয়াকে শর্ত করেন নি; বরং হাদিসসমূহ তার মূল উৎস হতে খুঁজে বের করতে সামর্থ্যবান হওয়া এবং হাদিসের প্রসিদ্ধ সংকলনসমূহের সাথে ভালোভাবে পরিচিত হওয়াই যথেষ্ট, যেমন সহিহ বুখারী, মুসলিম, সুনানু আবি দাউদ, সুনানুত তিরমিযী, সুনানুন নাসাঈ, সুনানু ইবন মাজাহ ও অন্যান্য।
এগুলোর মধ্যে কোন হাদিস সহিহ আর কোনটা দইফ সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা লাগবে।
২) যেসকল মাসআলার ওপর উম্মতের ইজমা রয়েছে তা জানা থাকা লাগবে।
৩) আরবি ভাষায় জ্ঞানী হতে হবে।
আরবি ভাষা একদম আত্মিকভাবে জানতে হবে এটা শর্ত করা হয়নি, তাকে ভাষার অর্থ জানতে হবে এবং বাক্যগঠন প্রণালী সম্পর্কে জানা থাকা লাগবে।
৪) তাকে উসূলে ফিকহ সম্পর্কে জ্ঞানী হতে হবে, এর মাঝে কিয়াসও অন্তর্ভুক্ত। কেননা উসূলে ফিকহই হচ্ছে ঐ ভিত্তি যার ওপর নির্ভর করে বিধিবিধান আহরণ করা হয়।
৫) তাকে নাসিখ(রহিতকারী) ও মানসুখ(রহিত) বিষয়ে জ্ঞানী হতে হবে… সমাপ্ত।
[দেখুন: ইরশাদুল ফুহূল: ২/২৯৭-৩০৩]
দ্বিতীয় উদ্ধৃতি, শাইখ মুহাম্মাদ বিন উসাইমিন رحمه الله হতে:
তিনি মুজতাহিদের যেসকল শর্ত উল্লেখ করেছেন তা ইমাম শাওকানী رحمه الله হতে খুব একটা ভিন্ন নয়, তবে তিনি তুলনামূলক সহজ ভাষায় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,
“ইজতিহাদের জন্য কিছু শর্ত রয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে-
১) ইজতিহাদের জন্য প্রয়োজনীয় শরঈ দলীল জানা থাকা লাগবে, যেমন আহকাম বিষয়ক আয়াত ও হাদিস,
২) হাদিস সহিহ নাকি দইফ তা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা লাগবে, যেমন সনদ ও তার রাবী বিষয়ক জ্ঞান ইত্যাদি,
৩) নাসিখ-মানসুখ ও ইজমার ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা লাগবে। যেন সে মানসুখ বিধান দিয়ে না বসে কিংবা ইজমা বিরোধী বিধান দিয়ে না ফেলে,
৪) তাকে ঐসকল দলীল জানতে হবে যার কারণে কোনো বিধান খাস (নির্দিষ্ট) হয়,শর্তযুক্ত হয় ইত্যাদি। যেন সে এর বিপরীত কোনো বিধান দিয়ে না বসে।
৫) তাকে আরবি ভাষা ও উসূলে ফিকহ সম্পর্কে জানতে হবে যা বিভিন্ন বিশেষ শব্দের অর্থ নির্দেশ করে, যেমন আম, খাস, মুতলাক, মুকাইয়্যাদ, মুজমাল, মুবাইয়্যান ইত্যাদি। যাতে করে তার দেয়া বিধান এসকল শব্দের চাহিদা মোতাবেক হয়।
৬) শরঈ দলীলসমূহ থেকে বিবিবিধান আহরণের সামর্থ্য তার মাঝে থাকতে হবে”
[আল উসূল মিন ইলমিল উসূল, পৃ: ৮৫-৮৬; এবং এর ব্যাখ্যা: ৫৮৪-৯০]
স্মর্তব্য যে হাদিসের কিতাবসমূহের পর্যাপ্ততার কারণে পূর্বের তুলনায় বর্তমানে সুন্নাতের দিকে ফিরে যাওয়া অধিক সহজ।
কাজেই যার মাঝে এই শর্তসমূহ পুরোপুরি পাওয়া যাবে সে-ই হচ্ছে “আলিম”, যিনি শরঈ দলীলসমূহ থেকে বিধিবিধান আহরণ করতে সক্ষম। যার মাঝে এই পরিমাণ সক্ষমতা নেই তাকে আলিম, ফকিহ বা মুজতাহিদ অভিধান ভূষিত করা সঠিক নয়।
এ বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিৎ: আলিম, মুজতাহিদ, ফকিহ- এই বিশেষণগুলো শরঈ পরিভাষা। আলিমদের কাছে এর পৃথক অর্থ রয়েছে, এর কিছু শর্ত রয়েছে, কাজেই যে কেউ-ই শরঈ বিধিবিধান নিয়ে কথা বলে, বা মাদ্রাসাসমূহ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্স দেয়, কিংবা আল্লাহর দিকে দাওয়াহ করে তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ব্যাপকভাবে শিথিলতার সাথে আলিম শব্দের প্রয়োগ বৈধ নয়।
একজন লোক দাঈ ইলাল্লাহ হতে পারে, এতে সে তার সামর্থ্য ব্যয় করতে পারে, কিন্তু এর মাধ্যমে সে আলিমের পর্যায়ে পৌঁছুতে পারে না।
نسأل الله تعالى أن يعلمنا ما ينفعنا ، وأن يزيدنا علماً .
والله أعلم
উৎস: islamqa.com,
প্রশ্ন নং: 145071
অনুবাদ: মানযুরুল কারিম।