সুরা আলে ইমরানের ১৯ সংখ্যক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার নিকট (গ্রহণযোগ্য) দীন কেবল ইসলামই।
ইসলাম হলো আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত সর্বশেষ নির্দেশনা। যা মানবতার পথ নির্দেশ, তার সাফল্য এবং পার্থিব-অপার্থিব কল্যাণ ও সৌভাগ্যের লক্ষ্যে প্রেরণ করা হয়েছিলো। এই অনিবার্য নেয়ামতের যত কৃতজ্ঞতায় জ্ঞাপন করা হোক না কেন যথেষ্ট হবে না। বর্তমানে দীন ইসলামের প্রশস্ত ক্ষেত্রে এমন কোনো জীবন বিধান নেই যার কোনো তুল্য হতে পারে। পৃথিবীতে এমন কোনো বিধান কিংবা আইন নেই ইসলাম নির্দেশিত বিধানের চাইতে যা শ্রেষ্ঠ ও অধিকতর কার্যকর হতে পারে। কারণ ইসলামী বিধি বিধান ও নির্দেশনা এমন যা বিশ্বস্রষ্টা স্বয়ং প্রণয়ন করেছেন এবং যার প্রতিটি ধারা আকল, ফিতরাত এবং বোধ ও স্বভা-রুচির সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।
বর্তমান সময়টাকে সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং উন্নতি ও অগ্রগতির কাল বিবেচনা করা হয়। প্রযুক্তি মানুষের জন্য এমন সব বিষয় অনায়াস ও সহজ করে দিয়েছে এক দেড় শতক পূর্বেও যার কল্পনা করা যেতো না। বিপরীতে এ কথাও সমান সত্য যে, এই প্রগতি ও অগ্রগতি বহু জাতি গোষ্ঠীর মাঝে ভুল উপলব্ধি ও চিন্তারও অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে। নানান রঙিন উদভ্রান্ত্র চিন্তায় আক্রান্ত করে তুলেছে মানবতাকে। আর মানুষ নিজেদের অসম্পূর্ণ বোধ ও বিবেচনা শক্তির মাধ্যমে এই পার্থিব ও জাগতিক উন্নতি অগ্রগতিকেই প্রকৃত উন্নতি ও সাফল্য ভেবে নিতে শুরু করেছে। এমনকি অহিয়ে ইলাহী ও নবী-রাসুলের নির্দেশনা উপেক্ষা করে, আল্লাহ তায়ালার নির্দেশিত পথ ও পন্থা এড়িয়ে গিয়ে বোধ ও বুদ্ধির দুর্বল ভিত্তির ওপর সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিপুলায়তন সৌধ নির্মাণ আরম্ভ করে দিয়েছে। তারই অবধারিত পরিণাম হলো, মানুষ আজ পার্থিব সকল সফলতা লাভ করবার পরও, সাফল্যের শীর্ষদেশ স্পর্শ করা সত্বেও অস্থির ও বেচাইন জীবন যাপন করছে। সে আরামে খানিক নিদ্রা যাবার জন্য বিভিন্ন আয়েশী বস্তুর মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে। হৃদয়ের উত্তাপ ও অস্থিরতা ভুলে থাকবার জন্য নানা ধরনের আনন্দদায়ী ব্যস্ততার সন্ধানে নেমেছে। স্নায়ুকে উত্তেজিত রাখবার লক্ষ্যে কামনা বাসনার পানে প্রবল বেগে ছুটে চলছে। ‘আধুনিক’ সভ্যতা সংস্কৃতির বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে সে সম্পর্কহীন হয়ে উঠছে নিজের জীবন ও জগৎ থেকে। স্বভাব-রুচির স্রষ্টা মানুষের রুচি ও স্বভাব প্রকৃতির জন্য যে নেজাম ও ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করেছিলেন, মানবতার নাস্তিক্যবাদী চিন্তা ফিতরাতের সেই ব্যবস্থাপনাকে পেছনে ছুঁড়ে ফেলেছে। নবী রাসুল আলাইহিমুস সালাম অহিয়ে ইলাহীর আলোকে মানব কাফেলার জন্য যে মহা সড়ক বিনির্মাণ করেছিলেন নয়া জামানার মানুষ সেই মহা সড়ক থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েছে। আজ মানুষ প্রবল বেগে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক, কিন্তু তাদের সেই ছুটে চলা সফলতা ও সৌভাগ্যের দিকে নয়; বরং ধ্বংস ও বিনাশের পানে।
ইসলাম হলো কল্যাণের ধর্ম। সে কল্যাণকামিতার কথা বলে। আর বর্তমান সময়ে মানবতার সব চাইতে বড় কল্যাণকামিতা হলো এটাই যে, মানবতার পথ বিচ্যূত কাফেলাকে গন্তব্যের সন্ধান দেয়া। মৃতপ্রায় মানবতাকে অহীয়ে ইলাহী এবং ইসলামি শিক্ষা-দীক্ষার সঞ্জীবনী সুধা পান করানো। মানবতার এই খেদমতের দায় ইসলামপ্রিয় ব্যক্তিদের ওপরই বর্তায় সর্বপ্রথম। ইসলাম তার প্রতিজন প্রকৃত অনুসারীকে বলে, তুমি মানবতার কল্যাণে এগিয়ে যাও। সভ্যতার ময়দানে উদভ্রান্ত মানবতাকে স্বচ্ছন্দ্য ও প্রাণশক্তি ফুঁকে দিতে উদ্যোগী হও প্রবল সমারোহে। মানবতার প্রকৃত কল্যাণ সুনিশ্চিত করা প্রতিটি ইসলাম-পছন্দ ব্যক্তির জন্য আবশ্যিক দায় ও কর্তব্য।
এই দায় ও কর্তব্য পালনের লক্ষ্যে মুসলমানদের চারটি বিষয়ের প্রয়োজন। প্রথমত ইসলামের উপযোগিতা বিষয়ে তাদের পূর্ণ আস্থা ও ঈমান থাকতে হবে। যেভাবে রোদ্রদায়ী সূর্যটি অজস্র বছর ধরে প্রতি ভোরে উদিত হয় আর সন্ধ্যায় অস্ত যায় এবং আজ পর্যন্ত কোনো বোধ-বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ তার উপযোগীতা বিষয়ে আস্থাহীন হয়নি; যেভাবে কোনো মানুষ আজ পর্যন্ত তার মধ্যে কোনো নতুনত্ব কামনা করেনি, তার রশ্মিতে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো ত্রুটি কিংবা অসম্পূর্ণতা অনুভব করেনি; ঠিক তেমনিভাবে একজন মুসলিমকে এই বিশ্বাস ও একিনে প্রোজ্জ্বল হতে হবে যে, ইসলামের যেই আলোকজ্জ্বল বিভাদায়ী সূর্য আজ থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে চমকে উঠেছিলো তা আজও সেভাবেই প্রোজ্জ্বল ও বিভাময় হয়ে আছে। এবং তার আলো সে সময় যেমন প্রাণ সঞ্চারী ছিলো আজও তেমনই প্রাণ প্রাচূর্যদায়ী রয়ে গেছে। ইসলাম-রবি সেদিন যেভাবে পূর্ণ ও ত্রুটিহীন ছিলো আজও তার প্রতিটি নির্দেশনা পরিপূর্ণ এবং ত্রুটিহীন আছে। যামানা যতোই বদলে যাক না কেন সূর্যের রশ্মি থেকে সে অমুখাপেক্ষী হতে পারে না। একইভাবে সভ্যতা ও সংস্কৃতির কাফেলা উন্নতি-অগ্রগতি ও প্রগতির যতো উঁচুতেই পৌঁছে যাক না কেন ইসলামের নূর ও প্রোজ্জ্বল আলোকবিভা থেকে কখওনই অমুখাপেক্ষী হতে পারবে না। আর তাই হৃদয়ে ঈমানের পোক্ততা নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত একজন মুসলমান জীবনের মহা সড়কে দৃঢ়পদ হতে পারবে না। পৃথিবীর নকীব ও নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠা তো আরও বহু দূরের কথা। নিকট অতীতে মুসলমানের ওপর কুফরের যে ছায়া বিস্তার লাভ করেছে এবং পৃথিবীর নেতৃত্বের আসন থেকে সরিয়ে তাকে যে দাসের জীবন অবলম্বনে বাধ্য করা হয়েছে তার সবচেয়ে বড় কারণ ঈমানের দুর্বলতা। এখন তাকে যদি পুনর্বার নেতৃত্বের পতাকা হাতে তুলে নিতে হয়, যদি বসতে হয় পরিচালকের আসনে তাহলে তাকে সর্বাগ্রে সুনিশ্চিত ও পোক্ত ঈমানের অধিকারী হয়ে উঠতে হবে।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, আমল ও নির্দেশ পালনের অভাবনীয় ক্ষমতা লাভ। আপনার কাছে প্রকৃষ্ট পথ্য বিদ্যমান আছে; কিন্তু তার প্রয়োগ করছেন না তাহলে সেই পথ্য যতো ভালো ও কার্যকরই হোক না কেন, তা থেকে সুস্থতার আশা করা যেতে পারে না। একইভাবে, কেবল মুসলমানদেরই নয়, বরং সমগ্র মানবতার সকল সমস্যা ও ব্যধির উপশম হলো ইসলাম। কিন্তু কখন? যখন আমরা তার বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটাবো। যখন আমরা তার প্রতিটি বিধানকে আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করবো। ফলে মুসলমানদের সুনিশ্চিত করতে হবে যে, তারা ইসলামের বিধি বিধান পালনে কোনো বিভাজন রাখবে না। ইসলামের কিছু বিষয় মান্য করবে আর কিছু বিষয়কে অকার্যকর ফেলে রাখবে–এমন আচরণ তাদের দ্বারা প্রকাশ পাবে না। বরং আল্লাহ তায়ালা তাদের জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত যতো বিধান নির্দেশ করেছেন সেগুলোকে পরিপূর্ণভাবে আত্মস্ত করে নিবে এবং ইবাদাত, এমনকি আখলাক, মুয়ামালাত, মুয়াশারাত, বিচার আচার আইন কানুনসহ সকল ক্ষেত্রে তার যথার্থ বাস্তবায়ন ঘটাবে।
তৃতীয় বিষয় হলো, কেবল নিজে ইসলাম পালনে মনোযোগী হওয়া এবং নিজের জীবনে ইসলামের বাস্তবায়ন ঘটানোর মধ্যেই একজন মুসলিমকে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। বরং প্রতিটি বিধান নিজে অনুসরণ করবার পাশাপাশি কথা ও কাজে, আমল ও কওলের সাহায্যে তার প্রচার প্রসার ও দাওয়াতেও উদ্যোগী হতে হবে।
আসলে, ঈমান-একিন-বিশ্বাস এবং দাওয়াত—এমন বিষয়, এ দুটি যদি কারুর অনায়াস হয়ে, স্বভাব-রুচি ও আত্মার সাথে মিশে যায় তাহলে সেই ব্যক্তি নিজেও প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠবে এবং কল্যাণী আলোয় উজালা করে তুলবে সমগ্র দেশ-কাল-জগৎও।
এসবের পাশাপাশি জরুরী চতুর্থ বিষয়টি হলো, অনৈসলামী যতো প্রতিবন্ধকতা আছে তার সব সমূলে উপড়ে ফেলতে হবে। ইসলামের পথে যা কিছু বাঁধা ও প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়: সমাজ-প্রতিষ্ঠিত অনৈসলামী যতো কুসংস্কার তার সব কিছুর অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। সেই সকল ভুল ত্রুটি ও সামাজিক আচার-বিচারের সংশোধন ও সংস্কার সাধন করতে হবে যা মূর্খতা অজ্ঞতা ও জাহেলিয়াতের দরুণ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে গেছে।
এই চারটি পদক্ষেপ গ্রহণে যদি আমরা যথার্থভাবে উদ্যোগী হতে পারি তাহলে মানবতার কল্যাণে ভূমিকা রাখা আমাদের জন্য অনায়াস হয়ে উঠবে। আর আমাদের মুসলিমদের জন্য মানবতার কল্যাণে ব্রতী হওয়ার চাইতে উত্তম প্রকল্প কী আছে!