যুগে যুগে শাতিমে রাসুল স.

যুগে-যুগে শাতিমে রাসুল সা. 

পর্ব-১

উস্তাদ মাহমুদ সিদ্দিকী 

১.

মুরতাদ ও শাতিমরা নবিজির সময় থেকে প্রায় সব যুগেই ছিল। কেউ প্রকাশ্যে বলার সাহস পেয়েছে, কেউবা পায়নি। যতদিন ইসলামি শাসন ছিল, ততদিন কোনো মুরতাদ বা শাতিম উল্লম্ফলন ও উন্মাদ নৃত্য করার সুযোগ পায়নি। বরং সাহসের অভাবে ঘোমটার নিচে নেচেছে। মুরতাদ ও শাতিমের ব্যাপারে শরিয়ত বরাবরই জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। হানাফি মাযহাবে শাতিমের শাস্তি মুরতাদের অনুরূপ। তওবার সুযোগের মারহালা পেরিয়ে পরবর্তীতে প্রাণদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়। শাফিয়ি মাযহাবের সিদ্ধান্ত হলো—শাতিম কাফির হলে সরাসরি হত্যা করা হবে। মুসলিম হলে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ বেশ কয়েকটি সুরত আছে। কিন্তু হাম্বলি ও মালিকি মাযহাবে শাতিমের শাস্তি সরাসরি; একটাই—প্রাণদণ্ড। তওবার কোনো সুযোগ নেই। শাতিম বাহ্যত মুসলিম হোক কিবা কাফির—শাস্তি একটাই।

এর প্রয়োগ কী হবে? কীভাবে হবে? এগুলো ফিকহের অধ্যায়। সে আলোচনা অন্যদিনের জন্য কিংবা অন্য কারও জন্য তোলা রইল। আমরা বরং একটু ইতিহাস থেকে ঘুরে আসি। তার আগে একটি আয়াত পড়ে নিই।

আল্লাহ তাআলা স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন—

إِنَّ الَّذِينَ يُؤْذُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأَعَدَّ لَهُمْ عَذَابًا مُّهِينًا ۞

“নিশ্চয় যারা আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলকে কষ্ট দেয়, 

আল্লাহ তাআলা তাদের উপর লানত করেন দুনিয়া ও আখেরাত—উভয় স্থানে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত করেছেন লাঞ্ছনাকর আযাব।” [সুরা আহযাব, আয়াত-৫৭।]

ইবনে আব্বাস রাযি. বলেন, “এই আয়াতে রাসুলকে কষ্ট দেওয়ার অংশটি নাজিল হয়েছে তাদের ব্যাপারে, যারা সফিয়্যা বিনতে হুয়াই রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বিবাহ করার কারণে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটু কথা বলে।”

হাফেয ইবনে কাসির রহ. বলেন, “একথা প্রকাশ্য যে, আয়াতটি ব্যাপকার্থবোধক। নবিজিকে যা-কিছুর মাধ্যমেই কষ্ট দিবে, তা এই আয়াতের অন্তর্ভুক্ত হবে। নবিজিকে যে কষ্ট দেয়, সে মূলত আল্লাহ তাআলাকে কষ্ট দেয়। আর নবিজিকে যে অনুসরণ করে, সে মূলত আল্লাহ তাআলাকে অনুসরণ করে।” [১]

তাহলে দেখা যাচ্ছে—দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গায় শাতিমরা লাঞ্ছিত ও অভিশপ্ত। এই বিধান আল্লাহ তাআলার দেওয়া। এখানে কুরআনের সরাসরি বয়ানের বাইরে গিয়ে কোনো মুসলিমের পক্ষে শাতিমের জন্য দরদী ও আবেগী হওয়ার সুযোগ নেই। শাতিমের জন্য আবেগ দেখানোর মানে হলো—আল্লাহ তাআলার এই আয়াত আপনার পছন্দ নয়। এর ফলাফল ইমানের জন্য বিপদজনক হওয়ার সমূহ আশঙ্কা আছে। দোয়া করি, আল্লাহ যেন সকল মুসলিমের অন্তর থেকে এজাতীয় অযাচিত দয়া উঠিয়ে নেন।

দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ তাআলা শাতিমকে অভিশপ্ত করেছেন। আল্লাহ যাকে অভিশাপ করেন, তাকে কীভাবে এবং কতভাবে লাঞ্ছিত করবেন, কীভাবে ও কতভাবে দুনিয়া ও আখেরাতে শাস্তি দিবেন—সেটা আল্লাহ তাআলা নির্ধারণ করে রেখেছেন। দুনিয়াতে হয়ত গজব দিবেন, নয়ত মুমিনের হাতে শাস্তি দিবেন। নানাবিধ মাধ্যম হতে পারে।

উক্ত আয়াতের সমার্থক ও কাছাকাছি শব্দের আরও স্পষ্ট আয়াত কুরআনে রয়েছে। প্রচ্ছন্নভাবে তো রয়েছেই। যার সারকথা হলো—শাতিমরা অভিশপ্ত এবং লাঞ্ছিত। তাদের প্রতি সিম্প্যাথি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই।

শাতিমের আহকাম সংক্রান্ত কিতাব আস-সারিম, আস-সাইফ ইত্যাদিতেও এই আয়াতটি দলিল হিসেবে আনা হয়েছে। এছাড়াও নবিজিকে ‘কষ্ট দেওয়া’ সংক্রান্ত যেসব আয়াত আনা হয়েছে, সেগুলোতে ব্যবহৃত শব্দ হলো—‘ইয়ুযুনা’; ‘কষ্ট দেয়’। এই কষ্ট দেওয়া অর্থের মূল শব্দটি হলো ‘আযা’। এখন প্রশ্ন হলো—এসব আয়াতে ‘আযা’ শব্দ দিয়ে নবিজিকে কষ্ট দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই আয়াত সামগ্রিক অর্থে হয়ত শাতিমকে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু স্পেসিফিকভাবে কি ‘আযা’ শব্দ দিয়ে কটুকাটব্য বা নিন্দা-তিরস্কার বোঝায়? এইসব আয়াতেইবা কি একথা বোঝানো হয়েছে?

প্রথমেই উপরোক্ত আয়াতের তাফসির সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রাযি. এর বাক্যটি আবার দেখা যাক। “এই আয়াতে রাসুলকে কষ্ট দেওয়ার অংশটি নাজিল হয়েছে তাদের ব্যাপারে, যারা সফিয়্যা বিনতে হুয়াই রাযিয়াল্লাহু আনহাকে বিবাহ করার কারণে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে কটু কথা বলে।” [২]

এই আয়াতেও কষ্ট দেওয়া বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দটি হলো ‘আযা’। এরপর ইবনে আব্বাস স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন আয়াতটি শাতিমদের ক্ষেত্রে নাজিল হয়েছে। তার মানে হলো—‘আযা’ শব্দটি কটুক্তি ও শাতম বোঝাতে কুরআনে ব্যবহৃত হয়।

এই প্রশ্নের উত্তর আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য নিচের আয়াতটি দেখা যাক। আল্লাহ তাআলা বলছেন—

لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا ۚ وَإِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَٰلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ۞

“অবশ্যই তোমরা তোমাদের সম্পদ ও প্রাণ নিয়ে পরীক্ষায় পড়বে। এবং অবশ্যই পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক ‘আযা’ শুনতে পাবে। আর যদি তোমরা ধৈর্যধারণ কর এবং পরহেযগারী অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের ব্যাপার।” [সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৮৬।]

এই আয়াতের শানে নুযুল প্রসঙ্গে কা’ব ইবনে 

মালিক রাযি. বলেন—“নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় আসেন, তখন মদিনাবাসীদের মধ্যে নানা ধর্মের লোক ছিল। মুসলমান, মূর্তিপূজারি, মুশরিক এবং ইহুদি। মুশরিক ও ইহুদিরা নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর সঙ্গীদেরকে কষ্ট দিত। তাদের ব্যাপারে এই আয়াত নাজিল হয়।” [৩] 

ইবনে কাসির রহ. বলেন, এই আয়াত বদরের যুদ্ধের আগের নাজিলকৃত। মদিনায় মুসলিমদের প্রথম দিককার কথা। এজন্য আয়াতের শেষাংশে তাদেরকে মাফ করে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। [৪]

আয়াতে ব্যবহৃত ‘আযা’ শব্দের ব্যাখ্যায় শরফুল হক আযিমাবাদি লিখেন—“এখানে আযা শব্দের অর্থ হলো—গালি দেওয়া, কটুক্তি করা এবং নারীদেরকে কবিতা লিখে উত্যক্ত করা।” [৫]

ইমাম আবু জাফর মুহাম্মাদ ইবনে জারির তাবারি রহ. এই আয়াতে ‘আযা’ শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন—“আহলে কিতাব ইহুদিদের কষ্টপ্রদানমূলক বাক্য হলো, ‘নিশ্চয় আল্লাহ ফকির, আমরা ধনী’ ও এই জাতীয় অপবাদমূলক বাক্য। খ্রিস্টানদের কষ্টপ্রদানমূলক বাক্য হলো—‘হযরত ইসা আল্লাহর পুত্র’ ও এজাতীয় কুফরি বাক্য।” [৬]

তাহলে দেখা যাচ্ছে, উক্ত আয়াতে প্রথমেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন— ‘‘তোমরা ‘আযা’ শুনতে পাবে।’’ ‘আযা’ শব্দের আগে শোনার কথা বলার মানেই হলো—পরবর্তী ‘আযা’ বা কষ্টপ্রদানের বিষয়টি দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কটুকাটব্য ও তিরস্কার করা। অন্য উপায়ে কষ্ট প্রদান এখানে উদ্দেশ্য নয়। এরপর শরফুল হক আযিমাবাদি সরাসরি গালি ও কটুক্তি অর্থ লিখেছেন। পরবর্তীতে ইমাম তাবারি রহ. স্পষ্ট উদাহরণ দিয়ে বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

সুতরাং যা বোঝা যাচ্ছে তা হলো, কুরআনে একাধিকবার ‘আযা’ শব্দ ও এর ক্রিয়াগুলো কটুক্তি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া নবিজিকে কষ্টপ্রদান সংক্রান্ত আয়াতগুলোর সাথে এই আয়াতের সমন্বয় করে পড়লে দেখা যায়—মদিনার ইহুদি ও মুশরিক কর্তৃক নবিজিকে কষ্ট দেওয়ার উপায়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল গালিগালাজ ও কটুকাটব্য করা।

২.

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযি. দীর্ঘদেহী কৃষ্ণবর্ণের সাহাবি। ফিতনার হাদিস সবচেয়ে বেশি যার কাছ থেকে বর্ণিত, সেই হুযাইফা রাযি. বলেন— ‘আমি সকলের ব্যাপারে ফিতনার সময়টা নিয়ে শঙ্কিত। শুধু মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাকে নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। কেননা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি— ফিতনা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ [৭]

হাফেয যাহাবি বলেন, মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু সবসময় ফিতনা এড়িয়ে চলতেন। জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে সিফফিনে তিনি অংশগ্রহণ করেননি। বরং একটি কাঠের তরবারি নিয়ে রাবাদায় চলে যান। সেখানে দীর্ঘকাল অবস্থান করেন। [৮]

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাকে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি তরবারি হাদিয়া দেন। সাথে নির্দেশ দেন—“যতদিন মুশরিকরা লড়াই করবে, ততদিন তুমি এই তরবারি দিয়ে তাদের সাথে লড়াই করবে। কিন্তু যখনই আমার উম্মতকে দেখবে একে-অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তখন তরবারিটি নিয়ে কারও কাছে যাবে। তারপর এমনভাবে আঘাত করবে, যাতে ভেঙে যায়। তারপর তুমি তোমার ঘরে বসে থেকো। যতদিন না কোনো ভুল হাত তোমাকে মেরে ফেলে, অথবা নির্ধারিত মৃত্যু এসে পড়ে।” মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা নবিজির নির্দেশ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেন। [৯]

যার সম্পর্কে সকল ফিতনা থেকে বেঁচে থাকার ভবিষ্যদ্বাণী নবিজি করে গেছেন, সেই মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা হলেন মদিনার প্রথম শাতিম হত্যাকারী বীর সাহাবি।

শাতিমদের শাস্তি খোদ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে শুরু হয়েছে। মদিনায় সর্বপ্রথম শাতিম হিসেবে হত্যা করা হয় কা’ব ইবনুল আশরাফকে। কা’ব ইবনুল আশরাফ কে ছিল? কা’ব ইবনুল আশরাফ ছিল মদিনার নিকৃষ্ট ইহুদি। 

কাবের সার্বক্ষণিক কাজ ছিল নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরোধিতার পাশাপাশি তাঁকে নিয়ে কটুক্তি করা। কা’ব ইবনুল আশরাফ বেশ ভালো মানের কবি ছিল। নবিজিকে অপমান করে নিয়মিত কবিতা রচনা ছিল তার প্রধানতম কাজ।

কা’ব যে শাতিম ছিল—এই পরিচয় বিশিষ্ট সাহাবি কা’ব ইবনে মালিক রাযি. মুখেই শুনুন। “কা’ব ইবনুল আশরাফ নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালি দিত এবং নবিজির বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কুরাইশ কাফিরদেরকে উস্কানি দিত।” [১০]

শেষ পর্যন্ত কা’ব ইবনুল আশরাফ নিবৃত না হলে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়। কা’ব ইবনুল আশরাফের হত্যা নিয়ে হাদিসের কিতাবগুলোতে স্বতন্ত্র শিরোনাম দিয়ে অধ্যায় কায়েম করা হয়েছে। সহিহ বুখারিতে কা’ব হত্যার বিস্তারিত বিবরণ বর্ণিত হয়েছে।

একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মজলিসে বসে আছেন। ঘোষণা দিলেন— ‘কা’ব ইবনুল আশরাফকে হত্যা করার জন্য কে প্রস্তুত আছ?’ এই ঘোষণা দেওয়ার কারণ, কা’ব ইবনুল আশরাফ নবিজিকে কষ্ট [আযা] দিত।

 ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি কি চান আমি তাকে হত্যা করি?’ —দীর্ঘদেহী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা দাঁড়িয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলেন নবিজিকে।

‘হ্যাঁ, আমি তা চাই।’ —নবিজির স্পষ্ট উত্তর।

‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, তাহলে অনুমতি দিন, আমি কৌশলে কিছু কথাবার্তা বলে আসি।’ —মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযি. আরজ করেন।

‘ঠিক আছে, অনুমতি দিলাম।’ —নবিজি জবাব দেন।

নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতি পেয়ে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা কা’ব ইবনুল আশরাফের বাড়িতে চলে যান। কৌশলী আলাপ শুরু করেন।

‘এই লোক আমাদেরকে দান করতে বলেছে। (অথচ এদিকে আমরা খেতে পাচ্ছি না।) একদম বিরক্ত করে ছেড়েছে। এজন্য আপনার কাছে এসেছি কিছু ধার-কর্জ নিতে।’ —মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা আগমনের কারণ ব্যক্ত করেন।

‘সোজা হিসেব, কসম আল্লাহর! তোমরাও তাহলে তাকে পুরো বিরক্ত করে ছাড়বে।’ —কা’ব সুবর্ণ সুযোগ ভেবে প্রস্তাব দিয়ে বসে।

‘আমরা তো তার অনুসরণ করি। তাই তাকে ছাড়তে চাচ্ছি না। দেখতে চাই তার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পৌঁছে। আপাতত আমরা চাচ্ছি আপনি আমাদেরকে এক/দুই ওয়াসাক খাবার ধার দেন।’ —ইবনে মাসলামা কৌশলে প্রস্তাব এড়িয়ে যান।

‘ঠিক আছে। তাহলে কোনোকিছু বন্ধক রেখে যাও আমার কাছে।’—কা’ব বলে ওঠে।

‘কী বন্ধক রাখতে চান আপনি?’—ইবনে মাসলামা প্রশ্ন করেন।

‘তোমাদের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রেখে যাও।’ —ধৃষ্টতার সাথে কা’ব প্রস্তাব দেয়।

‘আরে আপনি হলেন আরবের সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। আপনার কাছে আমরা স্ত্রী বন্ধক রাখি কীভাবে?’ —ধৈর্যের সাথে সাহাবি জবাব দেন।

‘তাহলে সন্তান বন্ধক রেখে যাও?’

‘সন্তান বন্ধক রাখি কীভাবে বলুন? মানুষ তো গালিগালাজ করবে। বলবে— ‘এক/দুই ওয়াসাক খাবারের বিনিময়ে ছেলে বন্ধক রেখে গেছে।’ এটা আজীবন আমাদের জন্য কলঙ্ক হয়ে থাকবে। তারচেয়ে আমরা অস্ত্র বন্ধক রেখে যাই।’ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এবার আসল প্রস্তাবটি দেন।

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু কা’ব ইবনুল আশরাফকে অস্ত্র বন্ধক রাখতে আসবেন বলে ওয়াদা দিয়ে আসেন। রাত হলে তিনি রওয়ানা দেন। সাথে তখন কা’বের দুধভাই আবু না-ইলা রাযি.। কা’ব তাঁদেরকে দুর্গের ভেতরে ডেকে নেয়। নিজেও নেমে আসে ঘর থেকে। পিছন থেকে কা’বের স্ত্রী উদ্বেগ জানায়—‘এই সময় কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আরে এরা মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এবং আমার ভাই আবু না-ইলা।’ —কা’ব ইবনুল আশরাফ স্ত্রীকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে।

অন্য বর্ণনামতে, কা’বের স্ত্রীর বাক্যটি ছিল এমন—‘আমি এক অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছি; যেন চুইয়ে-চুইয়ে পড়া রক্তফোটার শব্দ।’ আর কা’ব ইবনুল আশরাফের উত্তরটি ছিল এমন—‘আরে এরা হলো আমার ভাই মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এবং আমার দুধভাই আবু না-ইলা। আর সম্ভ্রান্ত মানুষকে রাতের বেলা আক্রমণ করতে ডাকলেও সে বের হয়।’

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এবং আবু না-ইলা ছাড়া সাথে আরও দুজন লোক নিয়ে যান। অন্য বর্ণনামতে, তিনজন লোক নিয়ে যান। যাদের নাম হলো—আবু আবস ইবনে জাবর, হারিস ইবনে আউস এবং আব্বাদ ইবনে বিশর রাযিয়াল্লাহু আনহুম। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা তাঁদেরকে আক্রমণের পুরো পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন। ‘কা’ব ইবনুল আশরাফ যখন নেমে আসবে, তখন আমি তার চুলের কথা বলে ঘ্রাণ শুঁকতে চাইব। যখন তোমরা দেখবে আমি ওর মাথা ধরে ফেলেছি, তখন তোমরা হামলা করবে।’ 

আরেকবার বলেন—‘আমার ঘ্রাণ শোঁকা হয়ে গেলে তোমাদেরকে শুঁকতে দিব।’

কা’ব ইবনুল আশরাফ বেশ সেজেগুজে নেমে আসে। গা থেকে তার ভুরভুর করে সুগন্ধি ছড়াচ্ছে। মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা কথা শুরু করেন—‘আজ অব্দি এত চমৎকার সুগন্ধি কোথাও দেখিনি।’ কা’ব পুলকিত চিত্তে জবাব দেয়—‘আমার কাছে  আরবের সবচেয়ে সুবাসিত ও সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ নারী আছে।’

‘আপনার মাথাটা কাছে নিয়ে একটু ঘ্রাণ শুঁকতে দেবেন?’ —ইবনে মাসলামা প্রশংসার সুরে বলেন।

‘অবশ্যই অবশ্যই।’—ইহুদি কা’ব সানন্দে সম্মতি দেয়।

মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযি. প্রথমে নিজে সুবাস নেন। তারপর সঙ্গীদেরকে শুঁকতে দেন। তারপর অনুমতির সুরে বলেন—‘আপনার মাথাটা একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?’ সম্মতি পেয়ে ঝট করে কা’ব ইবনুল আশরাফের মাথা ধরে নিজের কব্জায় নিয়ে নেন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা। সঙ্গীদেরকে নির্দেশ দেন—‘হামলা করো!’

সবাই মিলে ইহুদি কা’ব ইবনুল আশরাফকে হত্যা করেন। তারপর নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে এই আনন্দের সংবাদ প্রদান করেন। [১১]

এই হাদিস থেকে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযি. সরাসরি আক্রমণের কথা জানা না গেলেও হাফেয ইবনে হাজার রহ. এই ঘটনার সবগুলো বর্ণনা একত্রিত করে দেখিয়েছেন, মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা শুরুতে আক্রমণের পথ তৈরি করে দেন বটে। পরে আক্রমণ শুরু হয়ে গেলে মাথা ছেড়ে দিয়ে তিনিও আক্রমণ করেন

তাবাকাতে ইবনে সাদের সূত্রে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার বক্তব্য উল্লেখ করেন। ইবনে মাসলামা বলেন—“আমার তরবারিতে লাগানো ধারালো লোহার পাতটি বের করি। এরপর কা’ব ইবনুল আশরাফের নাভিমূলে ঢুকিয়ে দিই। তারপর আবারও হামলা করি। ধারালো লোহার পাত ঢুকিয়ে টেনে লজ্জাস্থান পর্যন্ত ফেঁড়ে ফেলি”।

সামগ্রিক বর্ণনা মিলিয়ে জানা যায়, ইহুদিরা চিৎকার শুনে সাহাবিদেরকে হামলা করতে চাইলেও পারেনি। পরবর্তীতে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তারা বিচার চাইতে এলে নবিজি কোনো বিচার করেননি। বরং কা’বের কটুক্তিসহ সকল অপরাধ তুলে ধরে তাদেরকে ফিরিয়ে দেন। সুনানে আবি দাউদের বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই দলটি পাঠানোর দায়িত্ব পালন করেন সা’দ ইবনে মুয়ায রাযি.। মোটকথা, এই শাতিম হত্যার কাজটি ছিল কয়েকজন সাহাবির সম্মিলিত পরিকল্পনার ফল। যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রাযিয়াল্লাহু আনহু। ইবনে হাজার রহ. উল্লেখ করেন, এই হত্যায় যারপরনাই নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহ সাহাবিগণ অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন। নবিজি খুশি হয়ে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা আদায় করেন। [১২]

টীকা :

[১] তাফসিরুল কুরআনিল আযিম, ৬/৫০১, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হিজরি। 

[২] তাফসিরুল কুরআনিল আযিম, ৬/৫০১, দারুল হাদিস, ১৪২৬ হিজরি। 

[৩] সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩০০০। 

[৪] তাফসিরুল কুরআনিল আযিম, ২/২০০। 

[৫] আউনুল মা’বুদ আলা সুনানি আবি দাউদ, পৃষ্ঠা-১২৭৬, শরফুল হক আযিমাবাদি, দার ইবনে হাযম।

[৬] জামিউল বায়ান আন তাউইলি আয়িল কুরআন, ২/৩৭৪, ইমাম তাবারি, মুয়াসসাসাতুর রিসালাহ।

[৭] আল-ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা, ৬/২৯। 

সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ২/৩৭১-৩৭২।

[৮] সিয়ারু আ’লামিন নুবালা, ২/৩৬৯। 

[৯] আল-ইসাবা ফি তাময়িযিস সাহাবা ৬/২৮। 

[১০] সুনানে আবি দাউদ, হাদিস নং-৩০০০। 

[১১] সহিহ বুখারি, হাদিস নং-৪০৩৭। 

[১২] ফাতহুল বারি, ৭/৪০৯-৪১২, মাকতাবাতুস সফা, ১৪২৪ হিজরি। 

শেয়ার করুন:

সাম্প্রতিক ব্লগ

ট্যাগ

অশ্লীলতা6 আকিদাহ বিষয়ক প্রশ্নোত্তর2 আখলাক1 আনুগত্য1 আমল31 আমল কবুলের শর্ত1 আসমা ওয়াস সিফাত11 ইবনে তাইমিয়াহ রহি.17 ইবনে তায়্যিমিয়া রহি.1 ইমাম আহমাদ ইবনে হামবাল রহি.3 ইশকে রাসুল স.3 ঈমান17 ঈমাম শাফিঈ রহি.1 উলামাকথন18 উসুলুস সুন্নাহ1 কবর1 কিয়ামত1 কুফর1 ক্বুরআন10 গাইরত2 জান্নাত2 জাহান্নাম2 জুমু'আ5 তাওহীদ14 তাফসীর4 দরসগাহ ম্যাগাজিন ২6 দাম্পত্য1 নারীবাদ1 পুঁজিবাদ1 প্রবন্ধ4 বদর1 বারাকাহ1 বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস0 বিচার ফয়সালা5 বিজ্ঞানবাদ1 বিবিধ প্রশ্নোত্তর1 বিশুদ্ধ তাওবাহ3 বিশ্বকাপ1 মাজমুঊল ফাতওয়া2 মানহাজ1 ম্যাগাজিন1 যাকাত1 রমাদান1 রামাদান হাদিস2 রোযা2 শয়তানের চক্রান্ত1 শাইখ আহমাদ মুসা জীবরিল হাফি.1 শাইখ উসাইমিন রহি.1 শায়েস্তা খান0 শাস্তি1 শিরক1 সমকামীতা1 সাওম3 সাম্প্রদায়িকতা1 সালাত1 সাহাবী1 সিয়াম2 সিরাত1 সূরা আন নাবা1 সূরা আল আনককবুত1 সূরা আল হাজ্জ1 সূরা মাউন1 সূরা হূদ1 হত্যা1 হদ1 হাদিসে কুদসী3 হামজা জর্জিস1 হাশর1

সাবস্ক্রাইব করুন