বিজ্ঞানবাদ
১. বিজ্ঞানবাদ মানে কী?
ইংরেজিতে সাইন্টিজম আর বাংলায় বিজ্ঞানবাদ। এখন প্রশ্ন হতে পারে বিজ্ঞানবাদ মানে কী? অক্সফোর্ড ডিকশনারির মতে বিজ্ঞানবাদের মানে হল বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও টেকনোলজির উপর অত্যধিক বিশ্বাস। অর্থাৎ বিজ্ঞানের উপর অন্ধের মত বিশ্বাস।
বিজ্ঞানবাদ বিজ্ঞানকে দেখে পরম সত্য হিসেবে। যে সত্য কখনো মিথ্যা হতে পারে না। এটাই জ্ঞানের একমাত্র বাস্তবিক উৎস। বিপরীতে সত্যিকারের বিজ্ঞান এভাবে নিজেকে ধ্রুব সত্য হিসেবে সবসময় ভাবে না। নিজেকে সর্বদা পরম সত্য মনে করে না। কারণ, বিজ্ঞান ভালো করেই জানে বিজ্ঞানবাদের গর্ভ থেকে আসা চিন্তা কখনোই ১০০% শুদ্ধ হতে পারে না। কেননা সময়ে সময়ে বিজ্ঞানের যুক্তি, ধারণা বদলায়। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান কখনো নীতিশাস্ত্রের বিরোধিতা করে না। যদি করত তাহলে নিউটন কখনোই তার ১২ টি সূত্র মানুষের সামনে উত্থাপিত করত না! আর এর বাস্তবিক উদাহরণ তো কোটি কোটি!
‘বিশুদ্ধ বিজ্ঞান’ মনে করে পৃথিবীতে অনেক অলৌকিক বাস্তবতা রয়েছে। যা কখনোই বিজ্ঞানের তত্ত্ব কথা দ্বারা প্রমাণিত করা যায় না। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান কখনোই মেটাফিজিক্স তথা আধ্যাত্মতত্ত্বের বিরোধিতা করে না। কিন্তু বিজ্ঞানবাদ করে। বিজ্ঞানবাদ সবকিছুতেই নিজের মত করে তত্ত্বকে গ্রহণ করতে চায়! আর এই জায়গাতেই এটি ভুল করে বসে। ফলে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানবাদে রয়েছে বিস্তর ফারাক। সহজ কথায় বলতে গেলে, যে তত্ত্ব নিজেকে খোদা বানাতে চায় সেই তত্ত্বই হল বিজ্ঞানবাদ।
২. বিজ্ঞানবাদ, বুদ্ধি ও ধর্মান্ধ গেঁয়ো ভূত
আমরা এমন একটি সমাজে বাস করি, যে সমাজ আমাদের মৌলিক সহজাত প্রবৃত্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয় যেন আমরা
একচেটিয়া ভাবে আমাদের বুদ্ধিকে অনুসরণ করি। বস্তুবাদীদের মতে, এই বুদ্ধিকে শুধুমাত্র বস্তুবাদ, বিজ্ঞানবাদ এবং যুক্তিবিদ্যার মধ্যেই কেবল খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অন্য কোথাও বুদ্ধিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মোটকথা আমাদের ‘মগজ বা বুদ্ধির’ উপর বিজ্ঞানবাদের প্রভাবের কারণে এটি যেটাকে ধ্রুব সত্য মনে করবে, সেটাই আসল সত্য।
বিজ্ঞানবাদ দ্বারা আমাদের শেখানো হয়, যে কোনো জিনিসকে (আধ্যাত্মতত্ত্ব) যদি আমরা সরাসরি স্পর্শ বা অনুভব করতে না পারি এর মানে হল—সেই জিনিসটার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। অর্থাৎ, অদেখা জিনিসকে পাত্তা দেওয়া যাবে না। সবকিছু বস্তবাদী বিজ্ঞানবাদের আলোকে ভাবতে হবে। এমনকি কোনো জিনিসের ভিত্তি আধ্যাত্মিকতার মধ্যে থাকলেও সে জিনিসকে গ্রহণ করা যাবে না। কারণ সেসবে কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতা রয়েছে।
বস্তুবাদী সমাজের মতে, এই পৃথিবীকে জানার একমাত্র উপায় হচ্ছে মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয় ও তার প্রায়োগিক দিক। অর্থাৎ, পঞ্চইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিয়ে
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই কেবল বুদ্ধিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তাদের মতে, বুদ্ধিকে বুঝার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হল এই পঞ্চইন্দ্রিয় ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। এগুলোর মাধ্যমেই কেবল পৃথিবীতে থাকা অনাবিষ্কৃত রহস্য উন্মোচন করা যায় এবং সেসব রহস্যই হল, একমাত্র ধ্রুব সত্য। বাকি যা আছে সেগুলো সব আজগুবি কথাবার্তা। এসব অদেখা কল্পকাহিনি যারা বিশ্বাস করবে তারা গেঁয়ো ভূত। অর্থাৎ বস্তুবাদ সমাজ বিজ্ঞানে নয় বিজ্ঞানবাদে বিশ্বাসী। এই পৃথিবীতে আমরা যা দেখি এবং যেসব জিনিসকে বাস্তবে ধরা যায়, ছোঁয়া যায় সেগুলোর বাহিরে যে আরও বহু সত্য থাকতে পারে, সেটা মানতে না পারা মতবাদই হলো বিজ্ঞানবাদ।
বিজ্ঞানবাদীদের মতে, যারা পৃথিবীর রহস্য জানে এবং পাশাপাশি ‘আধ্যাত্মিক তত্ত্বে’ বিশ্বাস করে না তারাই একমাত্র ‘মানুষ’। অর্থাৎ, যারা কথিত কলাবিজ্ঞানকে সমর্থন করে তারাই কেবল মানুষ। বাকিরা অন্যান্য দ্বিতীয় স্তরের প্রাণীদের মত, সোজা কথায় ধর্মান্ধ গেঁয়ো ভূত। বস্তুবাদ বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানবাদের বাহিরে যা কিছু আছে সবই ধর্মকেন্দ্রিক যুক্তিহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ‘বুদ্ধি’। আমাদের নৈতিকতা, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ইত্যাদি জিনিসগুলো জ্ঞানের আওতায় পড়ে না। যার জ্ঞান আছে সে কি এসব নৈতিকতা, নৈতিকতায় বিশ্বাস করতে পারে? না কখনোই না। যে করবে সে গেঁয়ো ভূত। আচ্ছা তাহলে প্রগতিশীল কারা? যারা বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের উপরে বিশ্বাসী তারাই কেবল মানুষ। প্রগতিশীল মানুষ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষকে ‘দিন ও রাত’ কনসেপ্টের মাধ্যমে আলাদা করা যায়। যারা প্রগতিশীল তারা ‘দিন’ আর যারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন গেঁয়ো ভূত তারা ‘রাত’।
গেবর মেইট একজন সমসাময়িক মনোবিজ্ঞানী। আমাদের বুদ্ধি বা তার বাহ্যিক রূপ ‘জ্ঞান’ থেকে ‘অন্তর্দৃষ্টির’ কৃত্রিম বিচ্ছেদের জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সহজাত প্রবৃত্তি ও আধ্যাত্মিকতাহীন অনুভূতিকে তিনি ‘নাড়িভুঁড়ির অনুভূতি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। মেইট যুক্তি দেন যে ‘বুদ্ধি’ কেবল সহজাত প্রবৃত্তি ও অনুভূতির উপরই নির্ভর করে। যখন আমাদের ‘যুক্তি ও চিন্তা’ থেকে অন্তর্দৃষ্টিকে আলাদা করা হয়, তখন সেই ‘চিন্তা’ পঙ্গুত্ব বরণ করে। কেননা ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বিশ্বজগত ও আমাদের সম্পর্কে জানার জন্য জ্ঞানের অন্যতম একটি উৎস। যখন আমরা বিজ্ঞানবাদের প্ররোচনায় নিজেদের ভেতরকার সহজাত প্রবৃত্তিকে বার বার দমন করার চেষ্টা করি, তখন আমরা সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন করা থেকে ছিটকে পড়ি।
জ্ঞানের অন্যতম উৎস যে ‘অন্তর্দৃষ্টি তথা আধ্যাত্মতত্ত্ব’ হতে পারে, যারা বস্তুবাদ বিজ্ঞানে বিশ্বাসী তারা এটা মানতে নারাজ। সেকুলারদের অনেকে ভাবে যে, বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি ও অন্তর্দৃষ্টি বিবর্তিত হয়েছ। মুসলিম হিসেবে আমাদের বিবর্তনের এসব তত্ত্ব কথার দরকার নেই। আমরা জানি যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা মানুষকে শারীরিক ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন —ইহকাল ও পরকালে বেঁচে থাকার এবং উন্নতি করার জন্য। আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা, খোরাক গুলো হলো পঞ্চইন্দ্রিয়, বুদ্ধি এবং সহজাত প্রবৃত্তি। আর সকল সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ‘ফিতরাত’। আর যারা এই ফিতরাতকে সঙ্গী করে দুনিয়াতে ভালো কাজ করে, তারাই পরকালে সফলতা অর্জন করে।