ঈমান কি?

উস্তাদ আহমাদ সাব্বির হাফি.

ঈমান মূলত একটি নূর; একটি জ্যোতির্ময় আলো। আল্লাহর রাসুলের সত্যায়নের মধ্য দিয়ে যেই নূর হৃদয়ে স্থাপিত হয়ে যায়। এই জ্যোতির্ময় আলো যখন ব্যক্তির হৃদয়ে প্রবেশ করে তখন কুফুর, অবাধ্যতা ও জাহেলী প্রথা পার্বন ও রসম রেওয়াজের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা কিছুর সংবাদ প্রদান করেছেন একজন মানুষ এই নূরের বিভাবিত দিব্য দৃষ্টিতে সেগুলো সব অকাট্য সত্য মনে করতে থাকে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে তার প্রবৃত্তিকে আমার আনীত এই দীনের অনুসারী না করবে’–এই নির্দেশনার বাস্তবায়ন তখন তার কাছে আর কঠিন কিছু থাকে না৷

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের কাছে যে দীন নিয়ে আগমন করেছিলেন সেই দীনের সব চাইতে তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ বিষয় হলো নিম্নোল্লেখ ছয়টি বিষয়৷ যেগুলোকে আমরা দীনের সারবত্তা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি৷

(১) আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান৷ যার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালাকে তার জাত ও সিফাত তথা তাঁর সত্ত্বা ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে একক মনে করা। তিনি নিজের অস্তিত্ব, সত্ত্বা ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে সকল প্রকারের ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত। সর্বদিক থেকে সম্পূর্ণ৷ বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তু তাঁরই ইচ্ছার অধীন, সব কিছু তারই মুখাপেক্ষী। তিনি কারোর মুখাপেক্ষি নন। বিশ্ব জগতের সমস্ত পরিচালন তারই হাতে। তার কোনো অংশীদার কিংবা কর্মের কোনো সঙ্গী নেই।

(২) ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান৷ এর অর্থ হলো, মনে-প্রাণে সর্বান্তকরণে এ কথা বিশ্বাস করা যে, ফেরেশতা সম্প্রদায় আল্লাহ তায়ালার বিশেষ এক সৃষ্টি। তারা কখওনই আল্লাহ তায়ালার বিরুদ্ধাচারণ করে না। বরং যে নির্দেশই তাদেরকে দেয়া হয় তারা দ্বিধাহীন তার বাস্তবায়ন করে। যাকে আল্লাহ তায়ালা যেই দায়িত্বে নিয়োজিত করেছেন সে এক মুহূর্তের জন্যও সে দায়িত্বে কোনো প্রকারের অবহেলা করে না।

(৩) রাসুলের প্রতি ঈমান৷ যার অর্থ, আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের হেদায়েত করবার লক্ষ্যে, তার সন্তোষ ও অসন্তোষ বিষয়ক কার্যকলাপ সম্বন্ধে অবগত করবার উদ্দেশ্যে কতিপয় পবিত্রতম ও উন্নত হৃদয় ব্যক্তিকে নির্বাচিত করেছেন। আর তাদেরকেই নবী ও রাসুল বলা হয়ে থাকে। মানুষ পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালার খবরাবর পৌঁছেছে নবী রাসুলদের মধ্যস্থতায়। মানুষের কাছে সর্বপ্রথম প্রেরিত নবী ছিলেন হজরত আদম আলাইহিস সালাম। আর সর্বশেষ প্রেরিত নবী হলেন হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পর পৃথিবীর কোনো ব্যক্তিই আর কোনো প্রকারের নবুওয়ত লাভ করবে না। বরং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনীত দীনই কেয়ামত দিবস অবধি প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

(৪) কিতাবের প্রতি ঈমান৷ যার অর্থ হলো, আল্লাহ তায়ালা তার নবী রাসুলদের নির্দেশনা প্রদানের লক্ষে অনেকগুলো আসমানী গ্রন্থ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে চারটি কিতাব সর্বাধিক প্রসিদ্ধ: তাওরাত। যেটা নাযিল হয়েছে হজরত মুসা আলাইহিস সালামের ওপর। যাবুর। যেটা নাযিল হয়েছে হজরত দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর। ইঞ্জিল। যেটা নাযিল করা হয়েছে হজরত ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর। এবং কুরআন কারীম। যে আসমানী গ্রন্থটি মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর নাযিল করা হয়েছে। কুরআন কারীম হলো বান্দার সমীপে আল্লাহ তায়ালার শেষ নির্দেশনামা। এখন সমস্ত মানব সম্প্রদায়ের জন্য তার অনুসরণ আবশ্যক। সমগ্র মানব সভ্যতার কল্যাণ ও মুক্তি নিহিত কুরআন কারীমের অনুসরণের মাঝেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার অবতীর্ণ এই শেষ গ্রন্থটি থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবে, তার নির্দেশাবলী মান্য করবে না তার ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে যে, সে ব্যর্থ হবে।

(৫) কেয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান৷ এর অর্থ হলো, এমন একটি সময় আসবে যখন সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আসমান জমিন নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়বে। তারপর আল্লাহ তায়ালা সকলকে পুনরায় জীবিত করবেন। এবং এই দুনিয়াতে যারা ভালো কিংবা মন্দ কাজ করেছে সবার হিসাব কিতাব সম্পন্ন করবেন। তখন ন্যায়ের দণ্ড প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রতিটি ব্যক্তির ভালো কাজ ও মন্দ কাজ পরিমাপিত হবে। যাদের নেক আমলের পাল্লা ভারি হবে তারা আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির পরওয়ানা লাভ করবে। এবং পরবর্তী সমস্ত কাল সে আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ ও নৈকট্যের মর্যাদায় সমাসীন থাকবে। তাকে দেয়া হবে চির সুখের ‘জান্নাত’। আর যে ব্যক্তির মন্দ পরিণামের পাল্লা ভারি থাকবে সে লাভ করবে আল্লাহ তায়ালার অসন্তোষ-ফরমান। তাকে আবদ্ধ করা হবে আল্লাহ তায়ালার কয়েদখানায়; চির দুখের জাহান্নামে। সেখানে সে তার কৃতকর্মের শাস্তি ভোগ করবে। যদি সে কাফের ও বেঈমান হয়ে থাকে তাহলে অনন্ত কালের জন্যই তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। পৃথিবীতে যে ব্যক্তি কারুর ওপর অবিচার করেছে, জুলুম বিস্তার করেছে তার থেকে মাজলুমের সকল প্রাপ্য বুঝে নেয়া হবে৷ মোটকথা, আল্লাহ তায়ালার ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার যে দিনটি, তার নামই কেয়ামত। যেদিন ভালো মন্দের যাচাই সম্পন্ন হবে, সকলকে তার জীবদ্দশার কর্মফল পরিশোধ করে দেয়া হবে, এবং কারো প্রতি সামান্য অবিচার করা হবে না।

(৬) ভালো ও মন্দ তাকদীরের প্রতি ঈমান আনা৷ এর অর্থ হলো, এই মহাবিশ্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবেই পরিচালিত হয় না। বরং একজন মহা প্রজ্ঞাবান ও সর্বজ্ঞাতা সত্ত্বা তাকে পরিচালিত করেন। এই বিশ্বজগতে আনন্দ-সুখের, বেদনা-দুঃখের যত ঘটনা সংঘটিত হয় তার সবই ওই মহান সত্ত্বার ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি অণু পরমাণু ও তার সার্বিক অবস্থা ওই সত্ত্বার গোচরে রয়েছে। বিশ্বজগত সৃষ্টিরও বহু পূর্ব থেকেই আল্লাহ তায়ালা এই বিশ্ব জগতের সার্বিক অবস্থাদি, যা কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, তার সবই লাওহে মাহফুজে লিখে রেখেছিলেন। তো, এখন এই বিশ্ব জগতে যা কিছু বাস্তবে রূপায়িত হচ্ছে তা আল্লাহ তায়ালার ওই চিরন্তন ইলমেরই বহিঃপ্রকাশ মাত্র৷ মোটকথা, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের যে ব্যবস্থাপনা আল্লাহ তায়ালা অনাদি থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন এই মহাবিশ্ব সেই নির্ধারিত ব্যবস্থাপনার অনুসারেই চলমান—অন্তরে এই বিশ্বাস স্থাপনের নামই তাকদীর৷

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দীন কেবল ইসলামই। আর উলামায়ে কেরাম বলেন, যেই দীন আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য উপরোক্ত ছয়টি বিষয়ই মূলত সেই ইসলামের সার৷ সুতরাং এই ছয়টি বিষয়ের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং সেগুলোর যথার্থ অনুসরণ ও বাস্তবায়নই একজন মুমিনের প্রধান সাধনা হওয়া উচিত৷ এর মাধ্যমেই পূর্ণতায় পৌঁছবে ব্যক্তির দীন ও ইসলাম।

—–
তথ্যসূত্র:
সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯
সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, হাদিস: ৯৩

শেয়ার করুন:

সাম্প্রতিক ব্লগ

ট্যাগ

অশ্লীলতা6 আকিদাহ বিষয়ক প্রশ্নোত্তর2 আখলাক1 আনুগত্য1 আমল31 আমল কবুলের শর্ত1 আসমা ওয়াস সিফাত11 ইবনে তাইমিয়াহ রহি.17 ইবনে তায়্যিমিয়া রহি.1 ইমাম আহমাদ ইবনে হামবাল রহি.3 ইশকে রাসুল স.3 ঈমান17 ঈমাম শাফিঈ রহি.1 উলামাকথন18 উসুলুস সুন্নাহ1 কবর1 কিয়ামত1 কুফর1 ক্বুরআন10 গাইরত2 জান্নাত2 জাহান্নাম2 জুমু'আ5 তাওহীদ14 তাফসীর4 দরসগাহ ম্যাগাজিন ২6 দাম্পত্য1 নারীবাদ1 পুঁজিবাদ1 প্রবন্ধ4 বদর1 বারাকাহ1 বাংলায় মুসলিম শাসনের ইতিহাস0 বিচার ফয়সালা5 বিজ্ঞানবাদ1 বিবিধ প্রশ্নোত্তর1 বিশুদ্ধ তাওবাহ3 বিশ্বকাপ1 মাজমুঊল ফাতওয়া2 মানহাজ1 ম্যাগাজিন1 যাকাত1 রমাদান1 রামাদান হাদিস2 রোযা2 শয়তানের চক্রান্ত1 শাইখ আহমাদ মুসা জীবরিল হাফি.1 শাইখ উসাইমিন রহি.1 শায়েস্তা খান0 শাস্তি1 শিরক1 সমকামীতা1 সাওম3 সাম্প্রদায়িকতা1 সালাত1 সাহাবী1 সিয়াম2 সিরাত1 সূরা আন নাবা1 সূরা আল আনককবুত1 সূরা আল হাজ্জ1 সূরা মাউন1 সূরা হূদ1 হত্যা1 হদ1 হাদিসে কুদসী3 হামজা জর্জিস1 হাশর1

সাবস্ক্রাইব করুন