ঈমান কী?
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা হলো: যে ব্যক্তি কালিমায়ে তাওহীদকে তার সমস্ত শর্তসহ পড়ে এবং এরপর এমন কোনো কথা-কাজে জড়িত হয়নি, যা সেই কালিমা থেকে বের করে দেয়, সে মুসলমান এবং সে নিশ্চয় কোনো একদিন জান্নাতে প্রবেশ করবে।
যেমনটি বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাযি. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন,
“যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে, অথচ তার হৃদয়ে একটি যবের ওজন পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) আছে, তাকেও জাহান্নাম থেকে বের করা হবে। তারপর বের করা হবে জাহান্নাম থেকে তাদেরকেও, যারা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে এবং তার হৃদয়ে একটি গমের ওজন পরিমাণ কল্যাণ (ঈমান) আছে। (সর্বশেষে) জাহান্নাম থেকে তাকে বের করা হবে, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়েছে এবং তার হৃদয়ে অনু পরিমাণ মাত্র কল্যাণ (ঈমান) আছে।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৬৯০৬ ই,ফা,)
মুসলমানের কাছে ঈমানের দাবি
কিন্তু সাথে সাথে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত এ কথায়ও একমত যে, কালিমা তখনই উপকার দেবে, যখন তার শর্তাবলিসহ পড়া হবে এবং এরপর তার দাবিসমূহ পূর্ণ করা হবে।
তাই এমন কিছু শর্ত তাতে আছে, যা পূর্ণ করা ব্যতীত মুখে কালিমা পড়া সত্ত্বেও মানুষ কাফের হয়ে যায়। তেমনি এমন কিছু বিষয় আছে, যা বলা বা করার কারণে মানুষ কালিমা পড়া সত্ত্বেও ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়।
“তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোযখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।”
(সূরা বাকারাহ : ২১৭)
আল্লাহর কুরআন কত এমন লোকের ব্যর্থতা ও বিফলতার কথা ঘোষণা করছে, যারা মুখে
কালিমা পড়ার দাবিদার। মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন- তারা
জাহান্নামের নিচের স্তরে থাকবে। যদি শুধু মুখে কালিমা পড়া পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট
হতো, তাহলে মুনাফিকদেরকে কাফেরদের চেয়ে কঠিন আযাব কেন দেওয়া হবে? বুঝা গেল,
কিছু শর্তের ভিত্তিতে মুখে কালিমা পড়া আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য।
আল্লাহ তা’আলা মুনাফিকদের অবস্থা বর্ণনা করে ইরশাদ করেছেন-
“আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ আদৌ তারা ঈমানদার নয়।”
(সূরা বাকারাহ : ৮)
“মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।”
(সূরা মুনাফিকুন : ০১)
“যে ব্যক্তি আমাদের ন্যায় সালাত আদায় করে, আমাদের কেবলামুখী হয় এবং আমাদের যবেহ করা প্রাণী খায়, সে-ই মুসলিম, যার জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যিম্মাদার। সুতরাং তোমরা আল্লাহর যিম্মাদারীতে খিয়ানত করো না।”
(সহীহ বুখারী : হাদীস নং- ৩৮৪, ই,ফা)
এ হাদীসের ব্যাখ্যা হলো- দ্বীন পূর্ণাঙ্গভাবে
মানতে হবে। কোনো কুফরী আবশ্যক করে এমন আকীদা, কথা বা কাজে জড়িত না হতে
হবে। এর এ অর্থ নয় যে, যে ব্যক্তিই এ তিন কাজ করবে, যত কুফরী আকীদা ও কাজে
জড়িত হোক না কেন; সে মুসলমান।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার পূর্ব পর্যন্ত
মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার আদেশ আমাকে দেওয়া হয়েছে। যে কেউ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
বলল, সে তার জীবন ও সম্পদ আমার পক্ষ থেকে নিরাপদ করে নিল। তবে ইসলামের
বিধান লংঘন করলে (শাস্তি দেওয়া যাবে), আর তার অন্তরের গভীরে (হৃদয়াভ্যন্তরে কুফরী
বা পাপ লুকানো থাকলে এর) হিসাব-নিকাশ আল্লাহর জিম্মায়।”
(সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১৩১৮, ই, ফা,)
এ হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রহ. বলেন-
‘কতিপয় সাহাবায়ে কেরাম মনে করেন, এর (উল্লিখিত হাদীস) ব্যাখ্যা হলো, শুধু এ কালিমা
পড়ে নেওয়া মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পারে। এ কারণে, তাঁরা যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করার উপর (প্রথমে) দ্বিধাবোধ করলেন। যখন আবূ বকর রাযি. তাঁদেরকে (এ হাদীসের
উদ্দেশ্য) বর্ণনা করলেন, সাহাবায়ে কেরামগণও তাঁর কথায় একমত পোষণ করলেন। এর
ব্যাখ্যা হলো- এগুলো এমন দু’টি বাক্য; যা তার দাবি ও শর্তাবলিসহ প্রযোজ্য। আর তা হলো,
ইসলামের অন্যান্য মৌলিক বিষয়সমূহ পালন করা।’
এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে, নবী এর ওফাতের পর যখন জাযিরাতুল আরবে ইরতিদাদের ফেতনা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, তখন এসবের মধ্যে অন্যতম ছিল যাকাত অস্বীকারকারীদের দল। তাদের মাঝে এমন মানুষও ছিল, যারা যাকাত অস্বীকার করত না;
তবে বলত যে, যাকাত নেওয়া রাসূল এরই বৈশিষ্ট্য ছিল। তাই এখন আমরা নিজেরাই যাকাত আদায় করব। হযরত আবূ বকরকে (জমা) দেব না। এ কারণেই হযরত আবূ বকর রাযি. তাদের সাথে যুদ্ধের ঘোষণা দেন।
‘হযরত আবূ বকর রাযি. বললেন, আল্লাহর কসম! তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চয়িই আমি যুদ্ধ
করবো, যারা সালাত ও যাকাতের মাঝে পার্থক্য করবে। কেননা, যাকাত হল সম্পদের উপর
আরোপিত হক।’
সে সময় হযরত উমর রাযি. বলেন, যে ব্যক্তি কালিমা পাঠ করেছে, তার জান-মাল নিরাপদ
হয়ে গেছে। তখন আবূ বকর রাযি. এ হাদীসের দলিল দিয়ে বলেন, সেই হাদীসে আছে,
অর্থাৎ তার জান-মাল নিরাপদ থাকবে না, যে কালিমা পড়ার পরও ইসলামের হকসমূহ
আদায় করেনি। আর যাকাত হলো ইসলামের হক। তাই আমি তাদের সাথে ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করব, যতদিন পর্যন্ত না তারা যাকাত আদায় করবে। এমনকি একটি উটের রশিও যদি তারা না দেয়, যা রাসূলের যুগে দিত; তার জন্যও যুদ্ধ চলবে।
এ কথা শুনে উমর রাযি.ও একমত হলেন। বললেন, আল্লাহর কসম! আল্লাহ তা’আলা আবূ
বকর রাযি. এর হৃদয়ের দ্বার খুলে দিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম রাযি. বলতেন, আবূ বকরই
আমাদেরকে ইরতিদাদ থেকে বাঁচিয়েছেন।
তেমনি এ হাদীসের ব্যাখ্যা করে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ফাতহুল বারীতে
বলেন-
‘উল্লিখিত হাদীস বিভিন্ন শব্দে বর্ধিত হয়ে এসেছে। হযরত আবূ হুরাইরার হাদীসে শুধু ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ উল্লেখ আছে। আবার তাঁরই (বর্ণিত) হাদীস সহীহ মুসলিমে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর সাথে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহও উল্লেখ আছে এবং ইবনে উমরের হাদীসে, যা আমি উল্লেখ করেছি। হযরত আনাস রাযি. এর হাদীসে কালিমার সাথে সালাত, কেবলা ও জবাইকৃত জন্তুর কথাও উল্লেখ আছে। ইমাম তবারী রহ. বলেন, প্রথম বর্ণনাটি মূর্তিপূজারী মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে এসেছে, যারা তাওহীদকেই অস্বীকার করে। দ্বিতীয় বর্ণনাটি এসেছে আহলে কিতাবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে, যারা তাওহীদের স্বীকারোক্তি তো দেয়; তবে নবী এর নবুওয়াতকে অস্বীকার করে। তৃতীয় বর্ণনাটি তাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, যারা ঈমান এনেছে তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি; তবে আল্লাহর দেওয়া ফরযসমূহ পালন করেনি। তাদের ব্যাপারে শরীয়তের নির্দেশ হলো, তাদের বিরুদ্ধে ততদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করতে হবে, যতদিন না তারা ফরয পালন আরম্ভ করবে।