শাইখ ড. আবদুল্লাহ ইউসুফ (রাহ.)- এর
সভ্যতা বিনির্মাণে আকিদাহ বইয়ের চতুর্থ অধ্যায় থেকে।
.
তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত | পর্ব- ১ |
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতসমূহের পরিচয়ঃ
আমরা জানি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নাম ও গুণসমূহ তাওকিফি; যা গ্রহণের ক্ষেত্রে শুধু ওহির ওপরই নির্ভর করতে হবে, হয় তা কুরআন থেকে অথবা সুন্নাহ থেকে।
ইমাম ইবনু খুযাইমাহ রহিমাহুল্লাহ (মৃ. ৩৮৬ হি.) তাঁর ‘আত-তাওহিদ’ গ্রন্থে বলেন, ‘হিজায, তিহামাহ, ইয়ামান, শাম ও মিশরসহ আমাদের সব আলিম-উলামার মাযহাব হলো, আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার জন্য ওই সব গুণ সাব্যস্ত করি, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা নিজের জন্য সাব্যস্ত করেছেন এবং এ বিষয়টি আমরা জবান দিয়ে স্বীকার করি, হৃদয় দিয়ে সত্যায়ন করি।’ [1]
সহিহাইন ও তিরমিযিতে বর্ণিত হয়েছে,
لِلَّهِ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ اسْمًا مِائَةٌ إِلَّا وَاحِدًا لَا يَحْفَظُهَا أَحَدٌ إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَهُوَ وَتْرٌ يُحِبُّ الْوَتْرَ
‘আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নিরানব্বইটি নাম রয়েছে, একটি কম একশতটি। যদি কেউ সেই নামগুলো সংরক্ষণ করে তাহলে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে। তিনি বেজোড় তাই বেজোড়কেই বেশি ভালোবাসেন।’ [2]
এ ছাড়াও অন্যান্য হাদিসে আরও কিছু নাম বর্ণিত হয়েছে। তবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার নাম নিরানব্বইটির মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। আবু বকর ইবনুল আরাবি রহিমাহুল্লাহ শারহুত তিরমিযিতে একদল আহলুল ইলম থেকে বর্ণনা করেন,
‘কিতাব ও সুন্নাহ থেকে তাঁরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার একহাজার নাম ও গুণ আহরণ করেছেন।’ [3]
ওইসব নামের মাঝে রয়েছে―الحنان, المنان, البديع, الكفيل ইত্যাদি। কুরআনে বর্ণিত আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কিছু সিফাত,
وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ
‘ধ্বংস হবে না কেবল তোমার মহামহিম ও চিরসম্মানিত রবের চেহারা।’ [সুরা রাহমান | ২৭]
إِنَّ الَّذِينَ يُبَايِعُونَكَ إِنَّمَا يُبَايِعُونَ اللهَ يَدُ اللهِ فَوْقَ أَيْدِيهِمْ
‘যারা তোমার কাছে বাইয়াত করে, বস্তুত তারা আল্লাহর কাছেই বাইয়াত করে। তাদের হাতের ওপর রয়েছে আল্লাহর হাত।’ [সুরা ফাতহ | ১০]
.
.
সিফাতের মাসয়ালায় চারটি মাযহাবঃ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সিফাতের ক্ষেত্রে মানুষ চারটি মাযহাবে বিভক্ত-
১. মুশাব্বিহাহ ও মুজাসসিমাহ [4]
তারা আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করে ঠিকই কিন্তু তারা বলে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আমাদের হাতের মতো হাত রয়েছে, আমাদের চোখের মতো তাঁরও চোখ রয়েছে, আমাদের মুখের মতো তাঁরও মুখমণ্ডল রয়েছে। এরা হলো দাউদ আল-জাওয়ারিবি, হিশাম ইবনুল হাকাম আর-রাফিদি। এটি মূর্তিপুজোর মতোই, তাদের এই মতবাদ কুফরি, যা তাদের মুসলিম উম্মাহ থেকে বের করে দেয়।
এই আয়াত তাদের বিরুদ্ধে বলে,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
‘কোনো কিছুই তাঁর মতো নয়। তিনি সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু দেখেন।’ [সুরা শুরা | ১১]
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ বলেন,
‘আমরা আমাদের সিফাতের সাথে তাঁর সিফাত তুলনা করব না, কারণ তুলনাকারী প্রতিমাপুজারি। আমরা কখনোই তাঁর সিফাত থেকে তাঁকে অবমুক্ত করব না,
কারণ সিফাত-বিলোপকারী অপবাদের নিমন্ত্রণকারী। যে মহামহিমান্বিত আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যস্থাপন করে সে খ্রিষ্টান মুশরিকদের জ্ঞাতিভাই, আর যে রাহমানের সত্তাকে তাঁর সিফাত থেকে বিলোপ করতে উদ্যত হয়, সে আল্লাহ-অবিশ্বাসী কাফির, ইমানহারা।’ [5]
২. মুয়াত্তিলাহ ও জাহমিয়াহ [6]
এরা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করে। তাদের ধারণা, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা শুনতে পান না, কথা বলতে পারেন না এবং দেখতেও পারেন না; কারণ, এসব কাজ তো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়। এই ফিরকাটি নির্ঘাত কাফির এবং মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ।
সালাফগণ বলেন,
المعطّل يعبد عدماً، والممثّل يعبد صنماً
‘মুয়াত্তিলারা অস্তিত্বহীনতার পুজো করে আর মুমাসসিলারা মূর্তির পুজো করে।’[7]
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘শিরকের মূল উৎস তাতিল, যার ওপর ভিত্তি করে শিরক মাথাচাড়া দেয়। এই তাতিল তিন প্রকারে বিভক্তঃ
(১) স্রষ্টাকে সৃষ্টি থেকে তাতিল করা।
(২) আল্লাহকে তাঁর পবিত্র নাম, গুণ ও কর্ম থেকে তাতিল করা।
(৩) বান্দার ওপর তাওহিদের হাকিকত আবশ্যকের কারণে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দার সাথে যে মুয়ামালাহ করেন বা করবেন, তা থেকে আল্লাহকে তাতিল করা।’ [8]
ইমাম ইবনুল কাইয়িম রহিমাহুল্লাহ বলেন,
كلا ولا نخليه عن أوصافه … إن المعطل عايد البهتان
আমরা কখনোই তাঁর সিফাত থেকে তাঁকে অবমুক্ত করব না, কারণ সিফাত-বিলোপকারী অপবাদের নিমন্ত্রণকারী। [9]
.
.
[দ্বিতীয় পর্বে তাওহিদুল আসমা ওয়াস সিফাত নিয়ে এই বইয়ে শাইখের বাকি আলোচনা- ৩. সালাফদের মাজহাব, ৪. খালাফদের মাজহাব ও ‘আমাদের মাজহাব’ শিরোনামে পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ্ ]
টীকা:
[1] কিতাবুত তাওহিদ লি ইবনি খুযাইমাহ, পৃষ্ঠা : ২৬
[2] বুখারি : ৬৪১০, মুসলিম : ৬৯৮৫; শব্দাবলি বুখারির।
[3] দেখুন, উস্তায হাসানুল বান্নার ‘আলআকায়িদ’, মাজমুয়াতুর রাসায়িল, পৃষ্ঠা : ৯৮৪
[4] মুশাব্বিহা অর্থ তুলনাকারী। এরা আল্লাহর সিফাতের সাথে সৃষ্টজীবের সাদৃশ্য দিয়ে থাকে। তারা বলে, আমাদের মতো আল্লাহর চেহারা, হাত, চোখ রয়েছে। এভাবে তারা আল্লাহর সাথে সৃষ্টির সাদৃশ্য দিয়ে শিরক করে। আল্লাহর জন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, দেহ সাব্যস্তকারীদের মুজাসসিমা বা দেহবাদী বলা হয়। (সম্পাদক)
[5] আলকাসিদাতুন নুনিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১২০
[6] তাতিল অর্থ শূন্যকরণ, নিষ্ক্রিয়করণ বা বাতিলকরণ। আল্লাহর কোনো সিফাতকে অস্বীকার করা। যারা তাতিল করে তাদেরকে মুয়াত্তিলা বলা হয়। জাহম ইবনু সাফওয়ানের (মৃত : ১২৮ হিজরি) অনুসারীদের জাহমিয়াহ বলা হয়। তার নামানুসারেই এই সম্প্রদায়ের নামকরণ। বনু উমাইয়াদের শাসনামলের শেষদিকে খুরাসান অন্তর্গত সামরকান্দ থেকে এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি ঘটে। এরা আল্লাহর সকল নাম ও সিফাতকে অস্বীকার করে। এদের মতে, ইমান কেবল অন্তরে জানা ও বিশ্বাস করা। মুখের স্বীকৃতি বা আমলকে এরা ইমানের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না। ফলে অন্তরে পরিপূর্ণ ইমানদার হয়েও কেউ আল্লাহর রাসুলকে গালি দিতে পারে, কুরআন ছুড়ে ফেলতে পারে, দ্বীনের শত্রুদের সাথে মিত্রতা করতে পারে, কাফিরদের পক্ষে মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে পারে। তাদের মতানুযায়ী এগুলো গুনাহ, এগুলো করেও কেউ আন্তরিকভাবে মুমিন হতে পারে; এগুলো ইমানে কোনো প্রভাব ফেলে না। জাহমিয়াহ মতবাদ সবচেয়ে নিকৃষ্ট মতবাদ। (সম্পাদক)
[7] মাজমুয়ুল ফাতাওয়া, ৫/২১৬
[8] আলজাওয়াবুল কাফি, পৃষ্ঠা : ৯০
[9] আলকাসিদাতুন নুনিয়াহ, পৃষ্ঠা : ১২